
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ঢাকাই চলচ্চিত্র পাড়ায় মুক্তি পেয়েছে প্রায় ২০টির মতো সিনেমা। তবে সংখ্যার দিক থেকে প্রবৃদ্ধি থাকলেও মান ও বাণিজ্যিক সফলতা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বছরের প্রথম প্রান্তিকে মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ সিনেমা দর্শক টানতে পারেনি, কিন্তু দুই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে ঢালিউডকে। বিশেষ করে শাকিব খান অভিনীত দুটি সিনেমা ও আফরান নিশোর 'দাগি' সিনেমা বক্স অফিসে আলোড়ন তুলেছে। প্রথম ছয় মাসে আলোচিত সিনেমাগুলোর ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে তৈরি হয়েছে নিচের বিশেষ প্রতিবেদন।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টা ঢাকাই সিনেমার জন্য ছিল অনেকটা নীরব। ‘মেকআপ’, ‘রিকশা গার্ল’, ‘বলি’, ‘ময়না’, ‘জ্বলে জ্বলে তারা’, ‘মধ্যবিত্ত’—এই সময়ের মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাগুলোর কোনোটিই উল্লেখযোগ্য দর্শকপ্রিয়তা কিংবা বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সিনেমাগুলো খুব বেশি আলোচনা তৈরি করতে পারেনি। শিল্প-সাহিত্যের কিছু মহলে প্রশংসা কুড়ালেও তারা মূলধারার বাণিজ্যিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অনেক প্রেক্ষাগৃহই দর্শক খরায় ভুগতে থাকে।
ঈদুল ফিতর: সাফল্যের সূচনা ‘বরবাদ’ দিয়ে
চিত্রপট বদলাতে শুরু করে এপ্রিলে ঈদুল ফিতরের সময়। পাঁচটি সিনেমা মুক্তি পেলেও সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে শাকিব খান অভিনীত ‘বরবাদ’। মেহেদী হাসান হৃদয় পরিচালিত এই সিনেমাটি ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চ বাজেটের সিনেমা হিসেবে বিবেচিত—বাজেট ছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা। শাকিব খানের সঙ্গে কলকাতার অভিনেত্রী ইধিকা পাল জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। একাধিক মাল্টিপ্লেক্স ও একক প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের বিপুল সাড়া পাওয়া যায়।
সিনেমা সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঈদ উপলক্ষে মুক্তির পর ৫০ দিনের মধ্যে সিনেমাটি ৭৫ কোটি টাকার বেশি আয় করে, যা চলমান সময়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রে এক বিরল রেকর্ড। মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে এটি টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে হাউসফুল শো উপহার দেয়।
‘দাগি’: নিশোর অভিষেক সিনেমায় নজরকাড়া সাফল্য
ঈদুল ফিতরে দ্বিতীয় আলোচিত সিনেমা ছিল আফরান নিশোর অভিষেক সিনেমা ‘দাগি’। জনপ্রিয় নির্মাতা শিহাব শাহীন পরিচালিত এই থ্রিলারধর্মী সিনেমায় নিশোর বিপরীতে ছিলেন তমা মির্জা ও সুনেরাহ বিনতে কামাল। চলচ্চিত্র সমালোচকরা নিশোর অভিনয় দক্ষতাকে প্রশংসায় ভাসান।
শহীদুজ্জামান সেলিম, রাশেদ মামুন অপুসহ শক্তিশালী পার্শ্ব চরিত্রের উপস্থিতি সিনেমাটিকে বহুমাত্রিক করেছে। প্রযোজনা সংস্থার মতে, সিনেমাটি প্রায় ১০ কোটি টাকার গ্রস সেল করেছে। একটি অভিষেক সিনেমা হিসেবে এটি দারুণ অর্জন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘জংলি’: সাহসী গল্প, মিশ্র সাড়া
ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি সিনেমা ‘জংলি’। পরিচালনা করেছেন এম রাহিম। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সিয়াম আহমেদ, শবনম বুবলি এবং প্রার্থনা দীঘি। এতে সিয়ামের অ্যাকশন-নির্ভর চরিত্র দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদিও প্রেক্ষাপট ও চিত্রনাট্যের জটিলতা নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকলেও, সিনেমাটির ভিজ্যুয়াল ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক প্রশংসিত হয়।
বাণিজ্যিক দিক থেকে সিনেমাটি প্রায় পাঁচ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঈদুল আজহা ঘিরে সিনেমা প্রেমীরা অপেক্ষায় ছিলেন, আর সেই অপেক্ষার ফসল ছিল শাকিব খান অভিনীত ‘তাণ্ডব’। পরিচালনায় ছিলেন তরুণ নির্মাতা রায়হান রাফী। সিনেমায় শক্তিশালী অভিনেত্রী জয়া আহসান ছাড়াও ছিলেন সাবিলা নূর, আফজাল হোসেন, ফজলুর রহমান বাবু, রোজি সিদ্দিকী ও শহীদুজ্জামান সেলিম।
একটি রাজনৈতিক-অ্যাকশনধর্মী চিত্রনাট্য নিয়ে তৈরি এই সিনেমা মাল্টিপ্লেক্সে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মুক্তির ২২ দিনের মাথায় সিনেমাটি প্রায় ১০ কোটি টাকার গ্রস সেল করে, যা ঈদের পরে ঢাকাই চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিকভাবে অন্যতম সফল সিনেমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
‘উৎসব’: ভিন্নধর্মী শিল্পের জয়গান
ঈদুল আজহায় দ্বিতীয় আলোচিত সিনেমা ছিল তানিম নূর পরিচালিত ‘উৎসব’। এক ঝাঁক তারকা অভিনীত এই সিনেমায় দেখা গেছে জাহিদ হাসান, আফসানা মিমি, জয়া আহসান, অপি করিম, চঞ্চল চৌধুরী, আজাদ আবুল কালাম, সুনেরাহ বিনতে কামাল, সৌম্য জ্যোতি ও সাদিয়া আয়মানকে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তরদ্বন্দ্ব, উৎসবের আড়ালে থাকা বাস্তবতা, এবং আন্তঃসম্পর্কের টানাপড়েন এই সিনেমার মূল থিম। যদিও এটি মূলত মাল্টিপ্লেক্সকেন্দ্রিক দর্শকদের টেনেছে, তথাপি সাড়ে তিন কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করে এটি প্রমাণ করেছে, শিল্পমান এবং কনটেন্ট-ভিত্তিক সিনেমাও দর্শক টানতে সক্ষম।
‘ইনসাফ’: সামাজিক বাস্তবতায় নির্মিত আলোচিত সিনেমা
ঈদুল আজহায় তৃতীয় আলোচিত সিনেমা ‘ইনসাফ’। নির্মাণ করেছেন সঞ্জয় সমাদ্দার। অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ, তাসনিয়া ফারিণ, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু, মিশা সওদাগর এবং চঞ্চল চৌধুরী অতিথি চরিত্রে।
চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিনেমাটি মাল্টিপ্লেক্সে এক কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করলেও সিনেমাটি আলোচনায় এসেছে সামাজিক বার্তা, বাস্তবভিত্তিক গল্প ও সমসাময়িক সমস্যা তুলে ধরার কারণে।
প্রথম ছয় মাসের ঢালিউড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বছরটা শুরু হয়েছিল ধীরগতিতে, কিন্তু দুই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলো সে ধারাকে পাল্টে দিয়েছে। শাকিব খানের ‘বরবাদ’ ও ‘তাণ্ডব’, নিশোর ‘দাগি’, জয়ার ‘উৎসব’ এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটভিত্তিক ‘ইনসাফ’—এই সিনেমাগুলো প্রমাণ করেছে, বৈচিত্র্যময় গল্প, তারকাবহুল অভিনয় ও উন্নত নির্মাণশৈলী থাকলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহমুখী হয়।
২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে আরো যেসব বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে, তাতে ঢাকাই সিনেমার এ পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া আরও বেগবান হবে বলে আশা করছেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ