
ছবি: সংগৃহীত
ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এক ঐতিহাসিক ও কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘর্ষের পর পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রেক্ষাপটে ইরান আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-র সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার (২ জুলাই) দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মাসউদ পেজেশকিয়ান এই সংক্রান্ত একটি নতুন আইন অনুমোদন করেছেন, যা তেহরানের পরমাণু নীতিতে একটি বড় মোড় এনে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার বরাত দিয়ে জানা যায়, ইরানের পার্লামেন্ট সম্প্রতি একটি প্রস্তাব পাস করেছে যাতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে পারমাণবিক তথ্য ও পরিদর্শন সংক্রান্ত সহযোগিতা স্থগিতের আহ্বান জানানো হয়। এই প্রস্তাবের আলোকে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান নতুন আইনটিতে স্বাক্ষর করেন।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, এখন থেকে আইএইএ পরিদর্শকদের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে প্রবেশের আগে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো আন্তর্জাতিক পরিদর্শক আর তেহরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ঘোষণা করেছেন যে আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি এখন আর ইরানে প্রবেশ করতে পারবেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, “গ্রোসি সম্প্রতি ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো ভয়াবহ হামলার কোনো নিন্দা জানাননি। একজন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে এরকম পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।”
আরাগচি আরও বলেন, “যুদ্ধবিধ্বস্ত পারমাণবিক কেন্দ্রে গ্রোসি পরিদর্শনের আবেদন করেছিলেন। তবে তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ এটি কূটনৈতিক আবরণে বিভ্রান্তিকর কৌশল ছাড়া কিছুই নয়।”
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন ইরানের শীর্ষ কট্টরপন্থী পত্রিকা ‘কায়হান’ দাবি করে বসে যে রাফায়েল গ্রোসি মূলত একজন “ইসরায়েলি গুপ্তচর” এবং তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা উচিত। যদিও এই ধরনের বক্তব্যের পর দেশটির সরকার জানিয়েছে, “আইএইএ প্রধান বা সংস্থার সদস্যদের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি।”
কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন বক্তব্য পারমাণবিক কূটনীতিতে এক নতুন সংকটের সূচনা করল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে এমন সময়, যখন পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করছে বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযুক্ত করে আসছে—যা ইরান বারবার অস্বীকার করে এসেছে।
ইরানের এই অবস্থান মূলত গত মাসের ভয়াবহ সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া। ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যৌথভাবে ইরানের ফোরদো, ইসফাহান ও নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে অভূতপূর্ব হামলা চালায়। এতে স্থাপনাগুলোর বড় অংশ ধ্বংস হয় এবং বিপুল প্রাণহানি ঘটে।
ইরানের বিচার বিভাগের মুখপাত্র আসগার জাহাঙ্গির জানিয়েছেন, ওই হামলায় ৯৩৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ১৩২ জন নারী এবং ৩৮ জন শিশু। আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ, নিখোঁজ রয়েছেন অনেক বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তা। বেশ কয়েকটি গোপন গবেষণাগার এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে বিস্ফোরণের কারণে দীর্ঘমেয়াদে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটেছে।
জবাবে ইরান ইসরাইলে পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী ২৮ জন নিহত হন। এ হামলায় বেশ কিছু সামরিক ঘাঁটি ও তেল সরবরাহ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এতসব ঘটনার পর ২৪ জুন দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি। বরং কূটনৈতিক স্তরে এই বিরোধ আরও তীব্র রূপ ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন-রাশিয়া পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইলেও ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়েই একে অপরকে দোষারোপ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে ‘সম্পূর্ণ সফল’ দাবি করে বলেন, “আমাদের হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।” তবে ইরানের পক্ষ থেকে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাগচি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু বোমা মেরে বিজ্ঞান ধ্বংস করা যায় না। আমাদের বিজ্ঞানীরা এখনও আছেন, আমাদের প্রযুক্তিও থাকবে।” তার এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে। ইরান অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে—তাদের কর্মসূচি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ গবেষণা ও জ্বালানি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে।
কিন্তু নতুন আইন, আইএইএ-র সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং গ্রোসি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ইরান কার্যত নিজেকে পারমাণবিক আলোচনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে—যা ভবিষ্যতের জন্য আরও জটিল সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মহল।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ বন্ধ হওয়ায় স্বচ্ছতা অনেকটাই হারাবে। পশ্চিমা দেশগুলো একে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। অপরদিকে, ইরান বলছে, তারা বারবার আগ্রাসনের শিকার, এখন আত্মরক্ষাই তাদের মূল লক্ষ্য।
এখন সবার দৃষ্টি আগামী সপ্তাহগুলোতে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য পদক্ষেপের দিকে। বিশেষ করে, এই আইন কার্যকর হওয়ার পর আইএইএ কী প্রতিক্রিয়া জানায় এবং তেহরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড কেমনভাবে সামনে এগোয়, তা নজরদারিতে থাকবে পুরো বিশ্বের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ