
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলমান ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক কূটনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রধান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর প্রস্তাবিত ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল সম্মতি জানিয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন এই শান্তি উদ্যোগ কেবল একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়, বরং তা একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তির ভিত্তি গড়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এই যুদ্ধবিরতির আওতায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নিবিড় কূটনৈতিক আলোচনা চলবে, যার লক্ষ্য হবে দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান খোঁজা এবং যুদ্ধ চূড়ান্তভাবে বন্ধ করা।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাতে ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যালে' দেওয়া এক বিবৃতিতে লেখেন— "আমার প্রতিনিধিরা আজ ইসরাইলি প্রতিনিধিদের সঙ্গে গাজা যুদ্ধ বিষয়ে একটি দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ বৈঠক করেছেন। ইসরাইল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ বন্ধের পথ খুঁজে পেতে কাজ করব।"
ট্রাম্পের এই ঘোষণা মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। যদিও তিনি তাঁর প্রতিনিধিদের নাম প্রকাশ করেননি, মার্কিন প্রশাসন ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
অন্যদিকে, ইসরাইলের কৌশলগত বিষয়কমন্ত্রী রন ডার্মারও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন এবং তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন সূত্রে আরও জানা গেছে, শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতার ও মিসরের প্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাঁরা হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই প্রস্তাব তুলে ধরবেন।
হামাসের অবস্থান বরাবরই বলে এসেছে, তারা যুদ্ধবিরতির পক্ষে এবং গাজায় বেঁচে থাকা ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে প্রস্তুত। তবে তাদের শর্ত, ইসরাইলকে আগ্রাসন বন্ধ করে গাজা থেকে পুরোপুরি সরে যেতে হবে এবং অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে।
হামাস এখনও ট্রাম্পের এই ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে, কাতার ও মিসরের চাপ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তারা আলোচনায় রাজি হতে পারে।
ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, "এই চুক্তি হামাসের জন্য সর্বোত্তম। তারা যদি এটিকে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।"
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে বলেছে, তারা যুদ্ধ শেষ করতে চায়, তবে সে ক্ষেত্রে হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং বিলুপ্ত করতে হবে। এই অবস্থান থেকে তারা এখনও সরেনি।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সা'র বলেছেন, "ইসরাইল আন্তরিকভাবে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়। তবে আমাদের নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করেই আমরা শান্তির পথে হাঁটব।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আমাদের সৈন্য এবং নাগরিকদের রক্ত দিয়ে নতুন বাস্তবতার জন্য মূল্য দিয়েছি। এখন সেই ত্যাগের প্রতিদান হিসেবে একটি টেকসই শান্তিচুক্তি চাই।"
গিডিয়ন সা'রের মতে, আব্রাহাম চুক্তির পরিধি আরও সম্প্রসারণের জন্য এ মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে নতুন দেশগুলো—যেমন লেবানন, সিরিয়া—শান্তিচুক্তির আওতায় আসতে পারে বলে তাঁর আশা।
মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ শিগগিরই মিসরের রাজধানী কায়রো সফর করবেন। সেখানে মিশরীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন এবং হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করবেন বলে জানা গেছে।
গোপন কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন হলে গাজা উপত্যকায় মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ সুগম হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার জন্য 'আব্রাহাম অ্যাকর্ড' নামে একাধিক চুক্তি সম্পাদন করেন। তিনি তাঁর বর্তমান শান্তি প্রচেষ্টাকে সেই ধারারই পরবর্তী ধাপ হিসেবে দেখছেন। গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করে নতুন দেশগুলোকে আব্রাহাম চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করাই ট্রাম্পের বড় লক্ষ্য বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
ফক্স নিউজ জানায়, এই যুদ্ধবিরতি ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশলের একটি বড় চাল। তিনি নিজেকে একজন 'শান্তির রূপকার' হিসেবে তুলে ধরতে চান এবং ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি কূটনৈতিক জয় দাবি করতে পারেন।
গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে এই ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছে। ইসরাইল সম্মতি জানালেও বাস্তবায়নের জন্য হামাসেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়িত হলে কেবল গাজা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিষ্ঠার পথ খুলে যেতে পারে।
এখন বিশ্বজুড়ে নজর কায়রো বৈঠকের দিকে। শান্তি কি গাজায় ফিরে আসবে? সময়ই দেবে এর উত্তর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ