
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র আর গোলাবারুদের তাণ্ডবের আড়ালে গাজার আকাশের নিচে এখন জন্ম নিচ্ছে আরেক নীরব বিপর্যয়—ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সুনামি। বন্দী উপত্যকার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক ভয়ংকর মানবিক সংকট, যার সবচেয়ে নির্মম শিকার হচ্ছে শিশু। তারা মারা যাচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে, ধুঁকতে ধুঁকতে—কোনো বিস্ফোরণ বা সরাসরি হামলায় নয়, বরং ক্ষুধার্ত পেট আর দুধহীন মুখ নিয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। গাজায় জন্ম নিচ্ছে এমন এক নিঃশব্দ গণহত্যা, যা যুদ্ধের চেয়েও নির্মম, হৃদয়বিদারক এবং নিষ্ঠুর।
ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলমান অবরোধ এবং মানবিক সহায়তা বন্ধের কারণে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ শিশু কেবল অপুষ্টির কারণে মারা গেছে। আর এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে হাজার হাজার শিশু আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে একই পরিণতির শিকার হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছে তারা।
গাজায় জন্ম নেওয়া এই ‘ক্ষুধার যুদ্ধ’ এখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতেও গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত কয়েক মাস ধরে ইসরাইল গাজার স্থলপথ ও আকাশপথে তীব্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। এই অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য, পানি, শিশুখাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এমনকি এক টিন দুধ পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারছে না। আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের মুখপাত্র ড. খালিল আল-দাকরান আলজাজিরাকে বলেন— “গাজায় এখন শিশুদের জন্য দুধের একটি টিনও নেই। আমরা শত শত শিশুকে শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কারণে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যেতে দেখছি।”
তিনি জানান, গাজায় বর্তমানে ৬০ হাজারের বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রতিদিন নতুন শিশুকে অপুষ্টির কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো—হাসপাতালগুলো কার্যত অচল। একদিকে চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি, অন্যদিকে চিকিৎসক ও সেবিকার সংকট সব মিলিয়ে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
ব্রিটেন থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক নার্স হ্যানা গ্রেস প্যান আলজাজিরাকে জানান— “আমি বহু যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতাল দেখেছি। কিন্তু গাজার অবস্থা ভিন্ন। হাসপাতালগুলো অচল হয়ে গেছে। শিশুরা পুড়ে যাওয়া শরীর, ভাঙা হাড় এবং ক্ষুধার যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, কিন্তু ব্যথা কমানোর জন্য এক ফোঁটা ওষুধ পর্যন্ত নেই। আমরা কেবল বসে বসে তাদের কাতরানো দেখছি।”
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ৫,০০০ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬৬ শিশুর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এ সংখ্যা যে আগামী দিনগুলোতে ভয়ানক হারে বাড়বে—এ বিষয়ে নিশ্চিত চিকিৎসকরা।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, “গাজার প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন এখন ‘বিপর্যয়কর মাত্রার ক্ষুধায়’ ভুগছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”
তিনি আহ্বান জানান—ইসরাইল যেন অবিলম্বে গাজার প্রবেশপথ খুলে দেয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবেশের সুযোগ দেয়। শুধু তাই নয়, ডুজারিক বলেন—ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় যেসব চরম সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা মানবতাবিরোধী বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে গাজার লাখ লাখ মানুষকে।
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মুখপাত্র ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডমেয়ার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন— “ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচাতে এখন একমাত্র সমাধান হচ্ছে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি। যতদিন যুদ্ধ চলছে, ততদিন ত্রাণ পৌঁছানো, চিকিৎসা দেওয়া বা খাদ্য সরবরাহ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
গাজা সংকট ঘিরে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, “আমি চাই গাজায় যুদ্ধ শেষ হোক, বোমা বন্ধ হোক এবং অবরোধ উঠে যাক। সব পক্ষ সম্মত হলে আগামী সপ্তাহেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতে পারে।”
হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লিভিট জানান, “গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরাইলকে বারবার বলছেন—তাদের উচিত মানবিক প্রবেশপথ খুলে দেওয়া এবং শিশুদের বাঁচানোর সুযোগ সৃষ্টি করা।”
একদিকে শিশুরা মারা যাচ্ছে ক্ষুধায়, অন্যদিকে ইসরাইলি সেনারা গাজায় বোমা বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইল ১৪০টি হামলা চালিয়েছে। এতে কমপক্ষে ১১৬ জন নিহত ও ৪৬৩ জন আহত হয়েছেন। শুধুমাত্র মঙ্গলবার সকালেই ৬০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
মার্চের শেষের দিকে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণকেন্দ্রে ইসরাইলি সমর্থিত হামলায় ৬০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। আর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৬,৬৪৭ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন ১,৩৪,১০৫ জনের বেশি।
গাজায় বোমার শব্দ যত ভয়াবহ, ক্ষুধার নিঃশব্দ চিৎকার যেন তার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক। একজন শিশুর কান্না, যার একমাত্র চাওয়া—এক চামচ দুধ; তার কাছে রাজনৈতিক কৌশল, ভূরাজনীতি কিংবা সামরিক জোটের ব্যাখ্যা মূল্যহীন।
একদিকে ইসরাইলি বর্বরতা, অন্যদিকে মানবিক সহায়তা অবরুদ্ধ করে রেখে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা মানব ইতিহাসে আরেকটি কল্পনাতীত ট্র্যাজেডি হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এখনই একসঙ্গে দাঁড়ানো—অবরোধ তুলে দেওয়া, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং শিশুদের বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
এই যুদ্ধের সবচেয়ে অসহায় শিকার যেসব শিশু, তাদের মুখেই এখন বিশ্ব বিবেকের প্রতিচ্ছবি। তাদের কান্নার শব্দ, একফোঁটা দুধের আকুতি আমাদের মানবতাকে প্রশ্ন করছে—আমরা কি শুনছি? আমরা কি কিছু করছি?
বাংলাবার্তা/এমএইচ