
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বর্তমান সরকার। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো দেশের সর্ববৃহৎ ও অর্থনীতির কেন্দ্রস্থল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস একদিনের জন্য বন্ধ ছিল—এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি। আর এই অচলাবস্থার মূল নায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. জাকির হোসেন। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে দফতর বন্ধ রাখা এবং ঢাকায় এনবিআরের চলমান আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করার দায়ে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বিভাগীয় তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপসচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সরকারি চাকরি (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩৯(১) ধারা অনুসারে মো. জাকির হোসেনকে বরখাস্ত করা হলো এবং তাঁকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, গত ২৮ জুন শনিবার এবং ২৯ জুন রোববার—এনবিআরের অধীনস্থ সকল রাজস্ব সংস্থার মতো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস খোলা রাখার নির্দেশনা ছিল সরকারের তরফে। উদ্দেশ্য ছিল—জাতীয় স্বার্থে রাজস্ব আদায় এবং আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখা। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে কমিশনার জাকির হোসেন ঢাকা এসে এনবিআরের আন্দোলনে যোগ দেন এবং নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন।
ফলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ভয়াবহ ব্যাঘাত ঘটে। কারণ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মাধ্যমে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। প্রতিদিন গড়ে ৩,০০০ থেকে ৪,৫০০ কনটেইনার (TEUs) পণ্য আমদানি হয়, যার বাজারমূল্য ১,০০০-১,৫০০ কোটি টাকা। একইসঙ্গে প্রতিদিন রপ্তানি হয় ২,০০০-৩,০০০ কনটেইনার, যার মূল্য ৫০০-৮০০ কোটি টাকা।
এই হঠাৎ অচলাবস্থায় সমুদ্রবন্দরে ৫০ হাজার টনের বেশি পণ্য লোড-আনলোড আটকে পড়ে এবং একদিনে কমপক্ষে ৩,০০০ কোটি টাকার সরাসরি বাণিজ্য ক্ষতি হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাব পড়বে আমদানি ব্যয়, ভোক্তা পর্যায়ের দাম এবং উৎপাদনশীলতার ওপর।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নানা সংকট দেখেছে—বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, এমনকি করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিও। কিন্তু কখনোই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বন্ধ থাকেনি। এমনকি ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালেও কোনোভাবেই এই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য রুট সম্পূর্ণ অচল হয়নি। অথচ এক কমিশনারের একক সিদ্ধান্তে দেশের অর্থনৈতিক প্রাণরসায়নের সেই কেন্দ্র—চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়লো।
শনিবার (২৮ জুন) কমিশনার জাকির হোসেন নিজের অফিস বন্ধ রেখে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের ঢাকায় এনবিআর সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য করেন। চট্টগ্রাম থেকে অফিসার ও কর্মচারীরা ঢাকায় গিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং ওই দুই দিন কাস্টম হাউস কার্যত তালাবদ্ধ থাকে।
সরকারি সূত্র বলছে, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ নামে পরিচিত গোষ্ঠীটি দাবি আদায়ের নামে চলমান সরকারবিরোধী একটি কৌশলগত আন্দোলনে জড়িত। বিগত দুই মাসে তারা কলম বিরতি, অফিস বর্জন, অবস্থান কর্মসূচি ও সর্বশেষ ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তবে এসব কর্মসূচির পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রমূলক চক্রান্ত ছিল বলে দাবি করছে সরকারের একাধিক সংস্থা।
তারা মনে করে, এই আন্দোলন ছিল একদিকে সরকারি কর্মপরিবেশ ধ্বংসের চেষ্টা এবং অন্যদিকে সরকারের আর্থিক প্রবাহ ও রাজস্ব খাতকে অচল করার ষড়যন্ত্র। আর সেই ষড়যন্ত্রে সরাসরি মাঠে নামা কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন মো. জাকির হোসেন, যিনি সরকারের আদেশ উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ধ করে দেন।
সরকারের উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই আন্দোলনে প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে যুক্ত থাকা এনবিআরের যেসব কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্ব অবহেলা করে আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছেন—তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে একটি গোপন তালিকা তৈরি হয়েছে।
বুধবার ও বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দুদক পৃথকভাবে অনুসন্ধান ও মামলা দায়ের করবে। পাশাপাশি এদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধে ইমিগ্রেশন বিভাগকে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে সরকার প্রতিবছর গড়ে ৭০,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে। এই রাজস্বই দেশের বাজেট বাস্তবায়নে একটি প্রধান খাত। একদিনের অচলাবস্থায় সরবরাহ শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটে, বন্দর ব্যয় বাড়ে, রপ্তানি বিলম্বিত হয় এবং আমদানির গন্তব্যে পৌঁছাতেও দেরি হয়।
এতে দেশের উৎপাদন খাত থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরাসরি প্রভাব পড়ে। ফলে শুধু একটি অফিস বন্ধ হওয়ার কারণে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনের সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সরকার কোনো ব্যত্যয় সহ্য করবে না। এই সিদ্ধান্তে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে—জনস্বার্থে কোনো কর্মকর্তা দায়িত্বে গাফিলতি করলে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অচলাবস্থা সৃষ্টি করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
এটি শুধু একজন কর্মকর্তার বরখাস্ত নয়—বরং এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব রক্ষায় সরকারের দৃঢ়তা ও নীতির প্রকাশ। আগামী দিনগুলোতে আরও যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী একই পথে হাঁটতে চাইবে, তাদের জন্য এটি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ