
ছবি: সংগৃহীত
ময়মনসিংহ জেলায় একদিনে দুটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১ জন মানুষ। শুক্রবার (২০ মার্চ) বিকেল ও রাতের দুই আলাদা ঘটনায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ফুলপুর ও তারাকান্দার সড়ক। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ময়মনসিংহ-হালুয়াঘাট সড়কের ফুলপুর উপজেলার কাজিয়াকান্দা ইন্দিরারপার এলাকায় ঘটে প্রথম দুর্ঘটনাটি। ওই সময় শ্যামলী বাংলা পরিবহনের একটি বাস হালুয়াঘাটগামী পথে ছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী মাহেন্দ্রর (থ্রি হুইলার) সঙ্গে বাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
প্রচণ্ড গতিতে চলমান দুই গাড়ির সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই ছয়জন যাত্রীর মৃত্যু হয়, যাদের মধ্যে একজন নারী রয়েছেন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় আরও অন্তত ৮ জনকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজন মারা যান।
ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া ইসলাম সীমা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করে জানান, “ঘটনাস্থলে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুইজন মারা যান। এখন পর্যন্ত নিহতদের নামপরিচয় আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।”
ময়মনসিংহ জেলা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. মাসুদ সরদার জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পরপরই ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ফুলপুর ফায়ার স্টেশনের ইনচার্জ লুৎফর রহমান জানান, মাহেন্দ্রর যাত্রীদের অধিকাংশই স্থানীয় কৃষক ও দিনমজুর ছিলেন। তারা বিভিন্ন কাজ শেষে ফিরছিলেন বাড়িতে। দুর্ঘটনার তীব্রতা এতটাই ছিল যে মাহেন্দ্রটি দুমড়ে-মুচড়ে একেবারে বাসের সামনের অংশে ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলে রক্তে রঞ্জিত হয়ে পড়ে মাহেন্দ্রর ধ্বংসাবশেষ।
এর আগে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কোদালধর বাজার সংলগ্ন হিমালয় ফিলিং স্টেশনের সামনে আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। একটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স হালুয়াঘাটের দিকে যাচ্ছিল, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে এর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
এই সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই সিএনজির দুই যাত্রী মারা যান। পরে গুরুতর আহত চালকসহ তিন যাত্রীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা যান বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন।
তারাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. টিপু সুলতান জানান, “এটি একটি ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষ ছিল। অ্যাম্বুলেন্সটি রোগী নিয়ে দ্রুত গতিতে চলছিল, অন্যদিকে সিএনজি যাত্রী নিয়ে আসছিল ময়মনসিংহ অভিমুখে। হঠাৎ মুখোমুখি সংঘর্ষে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আমরা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
পৃথক দুই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ময়মনসিংহ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী আখতার উল আলম। তিনি বলেন, “দুটি দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে যা বোঝা যাচ্ছে, তা হলো—দুই ক্ষেত্রেই বেপরোয়া গতি ছিল মূল কারণ। বাস ও অ্যাম্বুলেন্স—উভয় যানই গন্তব্যে পৌঁছাতে অতিরিক্ত গতি বজায় রেখেছিল, যা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়।”
তিনি আরও বলেন, “সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং এমন দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা কঠোরভাবে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, ড্রাইভারের লাইসেন্স ও যানবাহনের ফিটনেস যাচাই কার্যক্রম জোরদার করব। এ বিষয়ে তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এই দুই দুর্ঘটনায় এলাকার মানুষজন চরম আতঙ্কে ও শোকে মুহ্যমান। ফুলপুরের কাজিয়াকান্দা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রায়ই এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত গতি, লাইসেন্সবিহীন চালক আর অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের কারণে রাস্তাটা যেন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে।”
একইভাবে তারাকান্দার হিমালয় ফিলিং স্টেশনের কাছে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। অনেকে দাবি করছেন, এলাকায় গতিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্পিড ব্রেকার ও ট্রাফিক নজরদারির অভাবেই বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।
উভয় দুর্ঘটনার শিকার নিহত ব্যক্তিদের নামপরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ময়নাতদন্ত ও আত্মীয়স্বজনদের শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ জানিয়েছে, শনাক্ত হওয়ার পরই পরিবারকে খবর দেওয়া হবে এবং মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
এই ভয়াবহ প্রাণহানির পর সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভারের প্রশিক্ষণ, যানবাহনের রুট পারমিট ও ফিটনেস পরীক্ষার ওপর আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার সড়কে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন ও গতিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনার এই ধারাবাহিকতা রোধে প্রশাসন, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণের সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই। দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে এখনই প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ