
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুরুতে শুধুমাত্র রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকা এই মারাত্মক রোগটি এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল এলাকায় সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআর-এর বিশেষজ্ঞরা মশা নিধনে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে জোর দিচ্ছেন, অন্যথায় ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বরগুনার পরিস্থিতি এখন দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। তিনি বলেন, ‘বরগুনায় ডেঙ্গু সংক্রমণের হার রাজধানীসহ অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি। পানি জমে থাকা এবং স্যানিটেশন সমস্যা এখানে মূল কারণ।’ বরগুনায় পানি জমে থাকা স্থানগুলো সনাক্ত করে তা দ্রুত সরিয়ে ফেলা এবং এডিস মশার ডিম ধ্বংস করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে বরগুনায় সাড়ে ১৩ হাজার স্যালাইন পাঠিয়েছে, যা ডেঙ্গু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই যথেষ্ট নয়, স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, ‘ডেঙ্গু একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি চ্যালেঞ্জ। রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব আমাদের, কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।’ কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া সংক্রমণ বৃদ্ধির মাত্রা কমানো সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৫১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আশ্বস্ত করার বিষয় হলো, এই সময়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে চলতি বছরে মোট ৭ হাজার ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ৩০ জন মারা গেছেন।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে বহুতল ভবনে লার্ভার ঘনত্ব ৫৮.৮৮ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনে ১৯.৬৩ শতাংশ, একক বাড়িতে ৯.৮ শতাংশ। এসব এলাকা হলো কালশী, টোলারবাগ, মণিপুর, পীরেরবাগ, রামপুরা, মেরাদিয়া, বেগমবাজার, ওয়ারী, শাঁখারিনগর লেন, পোস্তগোলা, বাসাবো ও লালবাগের আশপাশ। জরিপ গত ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত হলেও ফলাফল যথাযথ কাজে লাগানো হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জানান, বর্তমানে শুধু ঢাকা নয়, দেশের ১১টি জেলা বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই জেলাগুলোতে গত দুই মাসে চার গুণ রোগীর বৃদ্ধি ঘটেছে। বরগুনা ও বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা গুলোতে বিশেষত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বরগুনা এখন ডেঙ্গু হটস্পট হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের বিশেষজ্ঞ দল ইতোমধ্যে সেখানে গিয়েছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। মশার ব্রুটো ইনডেক্স বেশিরভাগ এলাকায় ২০-এর ওপরে, যা খুবই বিপজ্জনক।’
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে এখনই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘বছরের শেষদিকে ডেঙ্গুর বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘শরীরের জ্বর হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে, কারণ অবহেলা করলে জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।’
ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বার বার রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছে এবং মশা নিধনের গুরুত্ব তুলে ধরছে। তবে সঠিক তথ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনকে সক্রিয় করতে হবে। জনগণকে নিজ নিজ এলাকায় পানি জমে থাকার জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। বরগুনা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। রোগী দ্রুত চিকিৎসা না নিলে জটিলতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই সময় সচেতনতা বৃদ্ধি, পানি জমে থাকা স্থান ধ্বংস ও মশা নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করার।
সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণকে যৌথভাবে এই ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। নইলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ