
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে এমন ধরেই এখন থেকে মাঠে সক্রিয় হয়েছে বিএনপি। শুধু আন্দোলন বা রাজনৈতিক বার্তা নয়, সংগঠনকেও নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চায় দলটি। এরই অংশ হিসেবে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠন, নতুন কমিটি গঠন এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকায় সংগঠনের গঠনমূলক কার্যক্রম থেকে অনেকটাই দূরে ছিল দলটি। তবে এখন নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন, সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী না হলে ভবিষ্যৎ রাজনীতি পরিচালনায় সমস্যা হতে পারে। সে কারণেই বর্তমানে বিএনপির সব মনোযোগ সংগঠনের ভিত মজবুত করার দিকে। দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ৯টি সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা, পৌর, থানা, মহানগর ও জেলা পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমিটি গঠন করতে হবে।
তবে বাস্তবচিত্র বলছে, এই প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হলেও তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাহত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, হিংসা-সংঘর্ষ এবং হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করার কারণে। বিশেষত ত্যাগী নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, দলের কঠিন সময় যাঁরা মাঠে ছিলেন না, এমনকি যাঁরা আওয়ামী লীগের ছায়াতলে থাকতেন, তারাও অনেক ক্ষেত্রে বিএনপির কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন। যার ফলে পুরনো ও পরীক্ষিত কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে দলটির হাইকমান্ড ৯টি সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্ব দেন ৯ সিনিয়র নেতাকে। এই নেতারা হচ্ছেন—রাজশাহী বিভাগে আব্দুস সালাম, সিলেট বিভাগে জাহিদ হোসেন, ময়মনসিংহে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, খুলনায় আমানউল্লাহ আমান, বরিশালে আব্দুল আউয়াল মিন্টু, রংপুরে শামসুজ্জামান দুদু, কুমিল্লায় বরকতউল্লা বুলু, ফরিদপুরে ড. আসাদুজ্জামান রিপন এবং চট্টগ্রামে আহমেদ আযম খান।
এদের প্রত্যেককেই চিঠি দিয়ে জানানো হয়, আগামী তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত সকল কমিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। সেই অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিভিন্ন জেলা, মহানগর, থানা ও উপজেলায় গিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম তদারকি করছেন।
ফরিদপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ড. আসাদুজ্জামান রিপন জানান, “এই সংগঠন একসময় মাঠে না থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। আমরা এখন তৃণমূলের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠন করছি। কমিটি যেন স্থানীয় কর্মীদের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, তা নিশ্চিত করাই এখন মূল লক্ষ্য।”
চট্টগ্রাম বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জানান, “চট্টগ্রাম দক্ষিণ, বান্দরবান ও নোয়াখালীর নতুন কমিটি ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। তারা আবার অধীনস্থ কমিটিগুলো পুনর্গঠনে কাজ করছে। বিভাগজুড়ে ৮০ শতাংশ কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়ে গেছে।”
তবে এই প্রক্রিয়া মোটেও নির্বিঘ্ন নয়। তৃণমূল থেকে পাওয়া অভিযোগগুলো বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই কাউন্সিল ছাড়াই একপক্ষীয়ভাবে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। আবার আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকা কিংবা বিতর্কিত পরিচয়ের ব্যক্তিদের কমিটিতে রাখা হচ্ছে। এতে করে মাঠে আন্দোলনে থাকা ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
উদাহরণস্বরূপ, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার একটি কমিটি অনুমোদনের ৯ দিনের মাথায় বাতিল করা হয়। অভিযোগ ছিল, কমিটিতে আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় থাকা ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন স্থানীয় নেতারা।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ঘটে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা। একইভাবে মাদারীপুরের রাজৈরে একটি ইউনিয়ন সম্মেলনে দুই পক্ষের হট্টগোল হয়।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “সংগঠনের প্রাণ ফেরাতে হলে প্রক্রিয়াগত কমিটি গঠন জরুরি। আগে ঢাকা থেকে তালিকা পাঠিয়ে কমিটি দেওয়া হতো, এবার তৃণমূলের মতামত নেওয়া হচ্ছে। অনিয়মের কিছু অভিযোগ থাকলেও আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো সমাধান করতে।”
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “দলের বিভাগীয় পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠে কাজ করছেন, বৈঠক করছেন। কমিটি গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে দলটি শক্তিশালী হচ্ছে।”
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের পর দীর্ঘ সময় ধরে রাজপথে অসংখ্য বাধার মুখে ছিল বিএনপি। সভা-সমাবেশ করতে পারেনি, সাংগঠনিক কার্যক্রম চলেছে গোপনে। এখন সেই অবরুদ্ধ সময় পেরিয়ে আবারও সারা দেশে সংগঠনকে সক্রিয় করতে চায় দলটি।
জানা গেছে, দেশের ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অধিকাংশই এখনো আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে। নভেম্বর ২০২৩-এর পর মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, মাগুরা, নাটোর, বান্দরবান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা দক্ষিণ, কুমিল্লা মহানগর, নরসিংদী, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদীতে সরাসরি ভোটে কমিটি গঠিত হয়েছে, যা বিএনপির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তৃণমূলের অনেক ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, উপজেলা ও পৌর কমিটিও নতুনভাবে গঠিত হয়েছে। তবে যেসব কমিটি এখনো গঠন হয়নি, সেগুলো নিয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দ্রুত কাজ করছেন বলে জানিয়েছে বিএনপি সূত্র।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে নিজেকে নতুনভাবে প্রস্তুত করছে। তারা বিশ্বাস করে, তৃণমূল থেকে শক্ত ভিত গড়েই রাজনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব। যদিও কমিটি গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ আছে, তবুও দীর্ঘ প্রতিকূল সময় পেরিয়ে এই কাজটিই এখন দলের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই সংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে চায় বিএনপি। এখন দেখার বিষয়, তারা সময়মতো সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে কি না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ