
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রবণতা মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের শঙ্কা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি—রাজনীতিক, আমলা এবং ব্যবসায়ী—বড় অঙ্কের অর্থ নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় বিদেশে পাচার করেন। এই চক্রের গন্তব্য সাধারণত কর-স্বর্গখ্যাত এবং আইনের শাসনসমৃদ্ধ উন্নত দেশগুলো।
বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থা যেমন—গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, আইসিআইজে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম রিপোর্ট—সবগুলোতেই বারবার উঠে এসেছে, নির্বাচনি বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের হার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়।
সবশেষ ২০২৪ সালেই তার প্রমাণ মিলেছে। ওই বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং নানা অস্থিরতা। এই পটভূমিতে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ গুণ বেড়ে যায়।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যেখানে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্র্যাংক (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৬৫ কোটি), সেখানে ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ ফ্র্যাংকে, যা প্রায় ৮ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা।
এই প্রবণতা আগে থেকেই দেখা যাচ্ছে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ও একই রকম দৃশ্যপট তৈরি হয়েছিল। সে সময়ও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংকে। ২০১৪ এবং ২০০৭ সালেও একই চিত্র—যেই বছর নির্বাচন, সেই বছর টাকা পাচারে নতুন রেকর্ড।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ প্রধানত পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের ১০টি দেশে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে: সংযুক্ত আরব আমিরাত (বিশেষত দুবাই), সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড।
এসব দেশের মধ্যে অনেকেই কর-স্বর্গ হিসেবে পরিচিত। আইন কঠোর হলেও সঠিক উপায়ে বিনিয়োগ, রিয়েল এস্টেট কিংবা সেকেন্ড সিটিজেনশিপের মাধ্যমে বিপুল অর্থ সেখানকার ব্যাংকিং বা বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় ঢুকে যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থ পাচারের পেছনে প্রধান পাঁচটি কারণ কাজ করে— দেশে বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পালাবদলের আশঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি ও জবাবদিহির অভাব, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং দুর্নীতির বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা অর্থ পাচারের অন্যতম উৎস। যখনই দেশের ভিতরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তখনই অর্থ দেশের বাইরে চলে যেতে থাকে।”
সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের টাকা পাচারের অন্যতম কেন্দ্র। জানা গেছে, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ঘুষ ও কমিশনের টাকা দেশেই না রেখে সরাসরি দুবাইয়ে ডলারে পরিশোধ করা হচ্ছে। এরপর সেখান থেকে সেই অর্থ ছড়িয়ে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, কানাডা ও ইউরোপে।
সিঙ্গাপুরেও বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম এবং সামিট গ্রুপের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
প্রতারণা, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ঘটনায় অনেক বাংলাদেশির নাম আন্তর্জাতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। আইসিআইজের পানামা, প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপার্স–এ ৯২ জন বাংলাদেশির নাম উঠে এসেছে। এদের মধ্যে আছেন— সাবেক মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী ও বিদেশে থাকা প্রবাসী রাজনৈতিক দালাল।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম—সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুল, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, ছাত্রলীগ নেতা নিশান মাহমুদ শামীম প্রমুখ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী: ২০০৯-২০২৪ মেয়াদে অর্থ পাচারের পরিমাণ ২৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। প্রতিবছর গড়ে পাচার হচ্ছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকায় ৭৮টি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব।
অর্থ পাচার রোধে সরকার নানা উদ্যোগের কথা বললেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পাচার ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে— আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, পাচারকারীদের শনাক্ত করে বিচার, বিদেশে থাকা টাকার তথ্য সংগ্রহ ও ফেরত আনার উদ্যোগ এবং হুন্ডির বিরুদ্ধে অভিযান।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, হুন্ডির প্রবণতা বাড়ছে। প্রবাসী আয়ের বড় একটি অংশ এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। ফলে বৈধ রেমিট্যান্স কমছে, আর অর্থ পাচারের সুযোগ বাড়ছে।
২০২২ সালে শেয়ারবাজারে বড় একটি জালিয়াতির ঘটনায় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস) চারটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২৩৫ কোটি টাকা তুলে নেয়। বিএসইসির তদন্তে দেখা গেছে, এর মধ্যে ইউএফএসের এমডি সৈয়দ হামজা আলমগীর নিজেই আত্মসাৎ করেছেন ১৭০ কোটি টাকা। এই অর্থও পাচারের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে, ততই অর্থ পাচারের প্রবণতা বাড়ে। আন্তর্জাতিক রিপোর্ট, সুইস ব্যাংকের তথ্য এবং শেয়ারবাজারে ঘটিত কেলেঙ্কারিগুলোর বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—দেশে জবাবদিহি ও আইনের শাসন না থাকলে অর্থ পাচার শুধু অব্যাহতই থাকবে না, বরং আরও বিস্তার লাভ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাচার রোধে শুধু বক্তব্য নয়, দরকার কার্যকর ব্যবস্থা। না হলে অর্থনীতির ভিতরে এই 'রক্তক্ষরণ' বন্ধ হবে না, আর বিদেশে গচ্ছিত টাকাগুলোও আর কোনোদিন দেশে ফিরবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ