
ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, আন্তর্জাতিক মহলে যখন যুদ্ধ থামানোর আহ্বান বাড়ছে, ঠিক সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—তিনি ইসরায়েলকে হামলা বন্ধ করতে বলবেন না। ইউরোপীয় দেশগুলোর চাপ, আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের আহ্বান এবং মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা—সবকিছু উপেক্ষা করে ট্রাম্প তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
তিনি বলেন, "ইসরায়েল এখন জয়ী অবস্থানে আছে এবং তারা খুব ভালো করছে। এই পরিস্থিতিতে জয়ী পক্ষকে থামতে বলা খুব কঠিন।" অর্থাৎ ট্রাম্পের দৃষ্টিতে ইসরায়েল 'লড়াই জিতে নিচ্ছে', তাই তাদেরকে এখন থামতে বলা কৌশলগতভাবে ভুল হবে। এমন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলেন, যারা ইরানে ইসরায়েলি বিমান হামলা বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা চাচ্ছিল।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জুন থেকে ইরানের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল টানা বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন ব্যবহার করে ইরানের কাশান, ইস্পাহান, নাতানজসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পারমাণবিক কেন্দ্র ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
এর জবাবে ইরানও সরাসরি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে তেহরান বেশ কয়েকটি শহরে আঘাত হানছে, যার মধ্যে ইসরায়েলের হাইফায় একটি বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২৩ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
উভয় পক্ষের এ সংঘাতে শতাধিক হতাহত এবং ব্যাপক ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে "নিয়ন্ত্রণহীন আগুন" ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা হিসেবে আখ্যা দিয়ে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলও জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বলেছেন, “শান্তির জন্য ইসরায়েলের সামরিক অভিযান বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি ভূমিকা প্রয়োজন।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ধরনের ‘টাইম-বাইং’ কৌশল নতুন নয়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে জটিল প্রশ্নে পড়লেই তার মুখে উচ্চারিত হয় পরিচিত এক শব্দ—‘দুই সপ্তাহ’। ট্রাম্পের প্রশাসনিক কৌশল ও রাজনৈতিক ভঙ্গিমায় এটি অনেকটা প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
তিনি এই 'দুই সপ্তাহ' সময়সূচি ব্যবহার করেছেন নানান ইস্যুতে—রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে আলোচনার সূচনা, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ সম্ভাবনা, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা পরিকল্পনা, এমনকি চীনবিরোধী বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রেও।
এই সময়সীমা সাধারণত নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে জনগণ, মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একধরনের অনিশ্চয়তায় রাখতে ব্যবহৃত হয়। এতে করে ট্রাম্প পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করার জন্য কিছুটা ‘স্পেস’ পান।
এবারও একই কৌশলের আভাস দেখা যাচ্ছে। যদিও ইউরোপ চাইছে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করুক, কিন্তু ট্রাম্প বরাবরের মতো এবারও সময় কিনছেন এবং নিজের অবস্থানে অটল থেকে নতুন করে আলোচনার ফ্লোর তৈরি করতে চাইছেন।
ট্রাম্পের এই অবস্থান শুধুই কূটনৈতিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসাবেও গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস বাকি। রিপাবলিকান ঘরানার নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসরায়েলঘেঁষা অবস্থান বরাবরই জনপ্রিয়। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিছুটা 'সতর্ক' নীতি গ্রহণ করলেও, ট্রাম্পের এমন খোলামেলা সমর্থন রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে ভালো বার্তা দিতে পারে।
এছাড়া ট্রাম্প মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ না করেও কৌশলগত মিত্রদের মাধ্যমে ‘শত্রুদের’ দুর্বল করা যায়। তিনি ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি বাতিল করেছিলেন। এখন আবারও ইরানকে কোণঠাসা করতে ইসরায়েলের চলমান হামলা ট্রাম্পের কৌশলগত স্বার্থে ‘সামরিক সাফল্য’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই অবস্থানে আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতাশা প্রকাশ করে বলেছে, “এই যুদ্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বে চরম নিরাপত্তা সংকট দেখা দেবে।” জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেসও বলেছেন, “এই সংঘাতের বিস্তার এমন এক আগুন জ্বালাতে পারে, যা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।”
এদিকে চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ বেশ কিছু দেশ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান যদি নিরপেক্ষ না হয়ে একপেশে থাকে, তাহলে কূটনৈতিক সমাধানের পথ আরও সংকুচিত হবে।
ইসরায়েল ও ইরানের চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বরাবরের মতো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ট্রাম্পের ‘হাত গুটিয়ে’ থাকা এবং ইসরায়েলের উগ্র সামরিক নীতিকে সমর্থন দেওয়া মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে। আন্তর্জাতিক আহ্বান, যুদ্ধবিরতির আবেদন, কিংবা কূটনৈতিক চেষ্টার পরও যুক্তরাষ্ট্রের নিরবতা অনেক বড় কূটনৈতিক সংকেত।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও প্রমাণ করলেন—তিনি সেই পুরনো ট্রাম্পই, যিনি জটিল প্রশ্নে ‘দুই সপ্তাহ’ সময় কিনে পুরো আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এবার এই কৌশল কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে যুদ্ধ থামবে কি না, আর তার কতখানি রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারবেন তিনি নভেম্বরের নির্বাচনে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ