
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজনীতির পরিসরে নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামোকে সুসংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ নিয়েছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দীর্ঘ আলোচনার পর দলটি তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করেছে। এতে নেতৃত্বে টানা পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখতে নতুন কিছু বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
চূড়ান্ত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে কেউই জীবদ্দশায় দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। একইসঙ্গে, কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার সর্বোচ্চ তিন মাস আগেই নতুন কাউন্সিলের মাধ্যমে পরবর্তী নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে।
এই সংবিধান অনুযায়ী, নেতৃত্বে রদবদল ও বিকেন্দ্রীকরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা স্বাগত জানাচ্ছেন, কারণ দেশের বহু দলেই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি বা পরিবার দীর্ঘ সময় দখল করে রাখেন।
শুক্রবার রাজধানীর বাংলা মোটরে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের গঠনতন্ত্রের বিস্তারিত তুলে ধরেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি জানান, সারা দেশের কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন—এটি দলীয় গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রয়েছে বলে জানান তিনি। নির্বাচনকালীন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের প্যানেল প্রথা বা লবিংকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলেও জানানো হয়।
গঠনতন্ত্রে রাজনৈতিক পর্ষদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম হিসেবে কাজ করবে। এই পর্ষদে সদস্য সংখ্যা হবে ১১ থেকে ১৫ জনের মধ্যে, যাদের প্রত্যেককেই দেশব্যাপী কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই পর্ষদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কমপক্ষে তিনজন নারী সদস্য রাখার বিধান রাখা হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও অঙ্গসংগঠন ও জেলার মর্যাদার কমিটি, উপজেলা ও থানার স্তরের কমিটিসমূহ নিয়ে গঠিত হবে জাতীয় কাউন্সিল। জাতীয় কাউন্সিল হবে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম, যেখানে গঠনতন্ত্র সংশোধন, বড় ধরনের নীতি পরিবর্তন এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এনসিপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটি, অঙ্গ সংগঠনের নির্বাহী কমিটি এবং জেলা কমিটির পাঁচজন করে সদস্য, উপজেলা ও থানার কমিটির দুজন করে সদস্য নিয়ে গঠিত হবে জাতীয় কাউন্সিল। এর মাধ্যমে দলের ভিতরে কার্যকর প্রতিনিধিত্ব এবং তৃণমূল পর্যায়ে কণ্ঠস্বর পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, এনসিপি এখনো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেনি। তবে দলটির সর্বশেষ সাধারণ সভায় এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শুক্রবারের ওই সভায় গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করার পাশাপাশি নিবন্ধনের বিষয়েও আলোচনা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০২৫ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের সুযোগ দিতে গত ১০ মার্চ একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্বাচন কমিশন। প্রাথমিকভাবে আবেদনের শেষ সময় ছিল ২০ এপ্রিল। পরে এনসিপিসহ কয়েকটি দলের অনুরোধে সময়সীমা দুই মাস বাড়িয়ে ২২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এনসিপি জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শেষ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন—আরিফুল ইসলাম আদীব, সামান্তা শারমিন, সারজিস আলম এবং আব্দুল হান্নান মাসউদ। তারা দলটির সাংগঠনিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পেছনের যুক্তিগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন।
নেতারা বলেন, এনসিপি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দলের মূল দর্শন হলো জবাবদিহিতা, নেতৃত্বে পরিবর্তন, রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির এই গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও তা চূড়ান্ত করার মধ্য দিয়ে নতুন ধারার একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দল গঠনের যে প্রতিশ্রুতি এনসিপি দিচ্ছে, তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক সংযোজন হতে পারে।
তবে এখন দেখার বিষয়—দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় কি না এবং ভবিষ্যতে সেই অনুযায়ী তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম কতটা কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ