
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে একটি শক্তিশালী ও মানবিক অবস্থান গ্রহণের জন্য সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি মিয়ানমারের উপর সর্বাত্মক কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান, যাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পথ তৈরি করা যায়।
বিবৃতিতে তারেক রহমান বলেন, “পৃথিবীর দেশে দেশে উদ্বাস্তু সমস্যা আজও ভয়াবহ ও অমানবিক রূপে বিদ্যমান। জাতিগত সহিংসতা ও রাজনৈতিক আদর্শগত দমন-পীড়নের কারণে সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে তাদের স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হতে হচ্ছে। এই ধরনের মানবিক সংকট শুধু কোনো একটি দেশের নয়, বরং এটি বৈশ্বিক মানবিক চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয় গ্রহণের বাস্তবতা তুলে ধরে বিএনপি নেতা বলেন, “কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির, যেখানে বর্তমানে ১৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তারা মিয়ানমারে সেনা অভিযানে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও বসতভিটা ধ্বংসের শিকার হয়ে ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।”
তারেক রহমান বলেন, “এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি মানবিক দায়িত্ব হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি একটি জটিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ শুধু ভূমি ও সম্পদের ওপর চাপ নয়, বরং নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার দিক থেকেও গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনই একমাত্র টেকসই সমাধান।”
তারেক রহমান অভিযোগ করেন, “মিয়ানমার সরকার দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাধিকবার প্রতারণা করেছে। তারা বাস্তব কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই আন্তর্জাতিক চাপে ‘সিম্বলিক’ উদ্যোগ নিয়েছে, যা কার্যত ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। প্রত্যাবাসনের জন্য যে ন্যূনতম নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন, মিয়ানমার সরকার তার কিছুই করতে চায়নি। বরং তারা এখনো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক নীতি অব্যাহত রেখেছে।”
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা, তাদের মানবিক দুর্দশা, বাংলাদেশের উপর এর বহুমাত্রিক চাপ এবং মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা নিছক একটি আঞ্চলিক সংকট নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক মানবিক বিপর্যয়।”
বিবৃতিতে বিএনপি নেতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা কেবল মানবিক সহায়তার জায়গায় আটকে না থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কূটনৈতিক অগ্রাধিকার তালিকায় রাখে। তিনি বলেন, “বর্তমান সরকার এতবছরেও আন্তর্জাতিক মহলকে যথাযথভাবে সংযুক্ত করতে পারেনি, মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা রোহিঙ্গাদের দুর্দশাকে দীর্ঘায়িত করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দিন দিন আরও বেশি বিপদাপন্ন হয়ে উঠছে। তাদের মাঝে হতাশা, অপরাধপ্রবণতা ও চরমপন্থার প্রবণতা বাড়ছে। এতে করে শুধু শরণার্থী শিবির নয়, পুরো অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে ভবিষ্যতে এর মূল্য আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও কূটনৈতিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও চরমভাবে পরিশোধ করতে হবে।”
তারেক রহমান বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ মানবিক মূল্যবোধ থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন তাদের নিজ দেশে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয় হতে হবে। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে একযোগে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিচারের দাবিকে জোরালো করা প্রয়োজন।”
তিনি বিএনপির পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে সবসময় সক্রিয় থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মূল বার্তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং নিজভূমিতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষদের স্বজনদের কাছে ফেরত পাঠানোর আন্তর্জাতিক আন্দোলনের পাশে থাকবে।”
তারেক রহমানের বিবৃতিটি রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক মানবিক ন্যায্যতার প্রতি দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। বাংলাদেশের জনগণ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মর্যাদার সঙ্গে উপস্থাপন করতে হলে কূটনৈতিকভাবে আরও জোরালো এবং কৌশলী হতে হবে। একইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করাই হবে একমাত্র পথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ