
ছবি: সংগৃহীত
গণমাধ্যম স্বাধীনতার প্রশ্নে বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি মুক্ত নয়, এখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যকর হয়নি মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার—এমনটাই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সোমবার (১৭ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনের পর কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও গণমাধ্যম এখনও সেই স্বৈরতান্ত্রিক, একদলীয় মানসিকতা ও দমননীতির ছায়া থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।
তারেক রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। সেদিন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা 'বাকশাল' (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) কায়েম করে। বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করে শুধু চারটি পত্রিকা রেখে বাকিগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। দেশের অন্যতম অগ্রসর সংবাদমাধ্যমগুলোকে জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়, হাজারো সংবাদকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। তাদের জীবিকা, পরিবার ও ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা ছিল দুইটি স্তম্ভে—ভৌগোলিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সেই চেতনাকেই পিষে ফেলা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, ভিন্নমতের দমন ও দুঃশাসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে একদলীয় সংকীর্ণতার পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
তারেক রহমানের ভাষায়, “বাকশাল কায়েম করে সেই শাসকগোষ্ঠী দেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে এক ভয়াবহ একনায়কতন্ত্র চালু করেছিল। রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে পুরো সমাজকে একটি চিন্তাশূন্য, ভয়-ভীতির সংস্কৃতিতে বন্দী করা হয়েছিল। এ অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এখনো গণমাধ্যমে বিদ্যমান। আজও অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সম্পাদক, সাংবাদিক ফ্যাসিবাদী ভয়, নিপীড়ন ও হুমকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।”
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তী একচেটিয়া ক্ষমতার সেই ঘোরতর অন্ধকার দূর করে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন। তার রাষ্ট্রনায়কত্বে সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ফিরে আসে, বেসরকারি টিভি ও রেডিওর পথ সুগম হয় এবং সাংবাদিকতার পেশাগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারেক রহমান আরও বলেন, “আজও আমরা সেই অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হইনি। ৫ আগস্ট ২০২৪-এ ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর জনগণের ভোটে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আমরা কিছুটা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি, কিন্তু তা পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হয়নি। পুরনো ক্ষমতাকাঠামোর অংশবিশেষ এখনো মিডিয়া হাউজগুলোর ওপর ছায়া বিস্তার করে আছে। এমনকি অনেক পেশাদার সাংবাদিক এখনো কাজ করছেন তদবির, সেন্সর ও হুমকির মধ্যে।”
তিনি মনে করেন, একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র কেবল ভোটাধিকারেই নয়, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারেই সুদৃঢ় হয়। স্বাধীন গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে, যা সমাজকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাঠামো দেয়। তার মতে, “স্বাধীনতা বলতে শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, মানুষের চিন্তা, ভাষা ও মতপ্রকাশের মুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত। আর গণমাধ্যম সেই মুক্তির সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।”
তারেক রহমানের বিবৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলাদাভাবে এক বিবৃতিতে বলেন, “গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা চাইলে আগে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। গণতন্ত্রহীন দেশে মুক্তমত থাকে না, সাংবাদিক থাকে না—থাকে শুধু প্রচারক বা সরকারের মুখপাত্র।”
তিনি বলেন, বিএনপি শুরু থেকেই গণতন্ত্রের, মতপ্রকাশের, ভিন্নমতের ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে আসছে। একাধিকবার সামরিক শাসন, একদলীয় দমননীতি, জরুরি অবস্থা ও রাজনৈতিক নির্যাতনের মুখেও বিএনপি তার বহুদলীয় গণতন্ত্রের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। “বিএনপি বহু মত ও পথের সহাবস্থানের পক্ষে। সেই কারণে আমরা বারবার দমন-পীড়ন সহ্য করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সোচ্চার থেকেছি।”
তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল উভয়েই বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, প্রয়োজন আইনি সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, দমনমূলক মিডিয়া নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক নজরদারি ব্যবস্থা বাতিল করে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বিজ্ঞাপন বণ্টনের ক্ষেত্রে দলীয়করণ বন্ধ করতে হবে, যাতে কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠান দমনমূলক প্রভাবের মধ্যে না পড়ে।
এছাড়া নতুন সরকারকে উদ্দেশ করে তারেক রহমান আহ্বান জানান, “একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকতে পারে না। একমাত্র স্বাধীন সংবাদপত্রই পারে সরকারের ভুল-ত্রুটি, দুর্নীতি ও অপব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে। তাই আমাদের সরকারব্যবস্থায় গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও কার্যকর করতে হবে।”
তারেক রহমানের এই বক্তব্য শুধু অতীত স্মরণ নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি রাজনৈতিক বার্তা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে তার এই মনোভাব রাজনৈতিক বিরোধীদের উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন এবং জনগণের উদ্দেশ্যেই স্পষ্ট বার্তা—ফ্যাসিবাদী শাসনের ছায়া এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি। আর তাই মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য চলমান সংগ্রাম থেমে থাকতে পারে না। বাংলাদেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ