
ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন রূপ নিচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় সোমবার (১৬ জুন) রাতভর ইসরায়েলের আকাশে শোনা গেছে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। পাশাপাশি, মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলের আকাশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বিমান হামলার সাইরেনের শব্দ।
রয়টার্স জানিয়েছে, ইরানের ছোড়া একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার সময় ইসরায়েলি আকাশসীমায় বিস্ফোরণ ঘটে। দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আয়রন ডোম ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। অন্যদিকে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের বহু অঞ্চলে বিমান হামলার সতর্কতা সাইরেন একাধিকবার বাজানো হয়েছে।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, এখন পর্যন্ত ইরানের হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের শিকার হওয়া অনেকগুলো লক্ষ্যবস্তু আগে থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা ছিল, যার ফলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত সক্রিয় হয়। এর আগেও ইসরায়েল দাবি করেছিল যে ইরান থেকে উৎক্ষেপণ করা বেশ কয়েকটি ড্রোন তারা মাঝপথেই ধ্বংস করে দিয়েছে।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার একটি টেলিফোন আলাপে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই উত্তেজনা দ্রুত নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন। দুই বিশ্বনেতা এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এছাড়া, ইরানের খ্যাতিমান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি জোট সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে তেহরান ও তেল আবিবকে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "এই যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই রক্তপাত বন্ধ করতে হবে এখনই।"
এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইরানের সঙ্গে সকল সীমান্ত পয়েন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে ইরান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে এই উত্তেজনার মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান-ইসরায়েল পরিস্থিতির ওপর সতর্ক নজর রেখে সোমবার দক্ষিণ চীন সাগর থেকে পশ্চিম দিকে রওনা হয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজ। জাহাজটির গন্তব্য এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করা হলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এটি পারস্য উপসাগর বা আরব সাগরের কোনো ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে পারে।
জাহাজ পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘মেরিন ট্রাফিক’-এর তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সোমবার সকাল নাগাদ ইউএসএস নিমিটজ দক্ষিণ চীন সাগর ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সামরিক তৎপরতা জোরদার করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী চলমান এই উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আরব লিগের পক্ষ থেকেও শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবু তেহরান এবং তেল আবিব—দুই পক্ষই আপাতত নিজেদের অবস্থানে অনড়।
সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এই হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে এক অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান না আসে, তাহলে এই সংঘাত আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে তৃতীয় পক্ষের জড়িত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে।
সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স, টাইমস অব ইসরায়েল, মেরিন ট্রাফিক, ডন নিউজ (পাকিস্তান)
বাংলাবার্তা/এমএইচ