
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ সরকারের ওপর বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণের চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রুটিন ব্যয় মেটাতে একদিকে যেমন রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলায় ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন পরিস্থিতিকে করে তুলেছে আরও জটিল। এই দুই চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে এখন সরকারের জন্য হয়ে উঠেছে এক বিরাট উদ্বেগের কারণ।
অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিবিবৃতিতে উঠে এসেছে, কেবল টাকার অবমূল্যায়নের কারণেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি যদি চলমান থাকে, তাহলে আগামী কয়েক বছরে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অর্থনীতি এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ৮ লাখ ২৬ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। তবে অর্থবছর শেষ হলে এই পরিমাণ বাড়বে সাড়ে ১৯ লাখ কোটি টাকার ওপরে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে যে খরচ বেড়ে যাচ্ছে তার বড় একটি অংশই নিয়ন্ত্রিত নয়। কারণ মূলত মার্কিন ডলার, ইয়েন, ইউয়ান ও অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার ক্রমাগত মূল্যহ্রাস এই ব্যয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমান বৈদেশিক ঋণের মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ মার্কিন ডলারে, ২২ শতাংশ জাপানি ইয়েনে এবং ৭ শতাংশ চীনা ইউয়ানে নেওয়া হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে, আগে যে পরিমাণ টাকা দিয়ে ডলার বা ইয়েন কেনা যেত, এখন তার দ্বিগুণের কাছাকাছি খরচ করতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের মূলধন পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে ২৬১ কোটি ডলার। ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৩৪ কোটি ডলারে। সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ এক লাখ কোটি এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম কে মুজেরি বলেন, "সরকারি রাজস্ব আহরণ এখনও আশানুরূপ নয়, অথচ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি আনতে বা অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। এই ঋণ আজ নয়, কাল ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই রাজস্ব আহরণ না বাড়ালে এমন এক সময় আসবে, যখন সরকার বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়ে যাবে।"
তিনি আরও বলেন, “দুর্নীতি, অপচয় ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বন্ধ করে উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিনিয়োগ করতে হবে। তবেই তা আর্থিকভাবে দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারবে।”
রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে সরকারকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা, কর কাঠামোর দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমেছে। এর প্রভাবে সরকার প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না।
একই সঙ্গে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য না আসা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতির কারণে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহও কমে গেছে। ফলে ডলার সংকট নিরসন হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগ একাধিকবার চেষ্টা করেও ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি। বর্তমানে ব্যাংক খাতে ডলারের দাম ১১৭-১১৯ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে, যা কয়েক বছর আগের তুলনায় প্রায় ৩০-৩৫ টাকা বেশি।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুযায়ী, একটি দেশ তার মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করলে সেটিকে নিরাপদ সীমা বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ঋণের অনুপাত ৩৭.৬২ শতাংশ, যা ২০২৭-২৮ অর্থবছরে পৌঁছাতে পারে ৩৭.৭২ শতাংশে। অর্থাৎ এখনও ‘ঝুঁকিমুক্ত সীমার মধ্যে’ থাকলেও ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারকে অবিলম্বে কয়েকটি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। সেগুলো হলো:
-
রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও কর ব্যবস্থায় সংস্কার
-
রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টি ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনা
-
প্রবাসী আয়ে ধারাবাহিকতা নিশ্চিতকরণ
-
ডলার রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স সহায়ক নীতি গ্রহণ
-
অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক ব্যয় কমিয়ে ঋণ গ্রহণ সীমিত রাখা
-
ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এখন এমন এক অর্থনৈতিক চক্রে প্রবেশ করেছে, যেখানে ঋণের চাপে পড়ে নতুন ঋণ নিতে হচ্ছে পুরোনো ঋণ ও সুদ শোধ করতে। এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিতে পারে।
তারা বলেন, সরকার যদি সময়মতো কার্যকর কৌশল গ্রহণ না করে, তবে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যয় সংকুচিত করতে হতে পারে, যা জনগণের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
সর্বোপরি, ঋণ ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রাজস্ব-রপ্তানি-রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো এবং টাকার মান রক্ষার জন্য আর্থিক নীতিতে সুসমন্বয় সাধন এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। অন্যথায় বাংলাদেশের অর্থনীতি এক দুঃসহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারে, যা থামানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ