
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতবিক্ষত ইরান এখনো শান্তিপূর্ণ অবস্থানেই দৃঢ়। দেশটির সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মাসুদ পেজেশকিয়ান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ইরানের কোনো দিনই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্য ছিল না, এখনো নেই। সোমবার (১৬ জুন) ইরানি পার্লামেন্টে দেওয়া এক আবেগঘন ভাষণে তিনি এই বার্তা দেন। চলমান সংঘর্ষ, আঞ্চলিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যে প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যকে ইরানের অবস্থান পরিষ্কার করার একটি কূটনৈতিক প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই বক্তব্য দিয়েছেন এমন সময়ে, যখন ইসরায়েলের লাগাতার বিমান হামলায় চার দিনে ইরানে প্রাণ হারিয়েছেন ২২৪ জন এবং পাল্টা ইরানি হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছেন ১৮ জন। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পারমাণবিক প্রসঙ্গ সামনে চলে আসায় আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, “ইরানের জনগণ কখনো আগ্রাসন চায়নি। আমরা যুদ্ধ চাই না, তবে আমাদের বিরুদ্ধে কেউ হাত তুললে আমরা চুপ থাকব না। শত্রুরা যদি ভাবে হত্যা, বোমাবর্ষণ, ষড়যন্ত্র আর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানের পতাকা নামিয়ে ফেলবে, তবে তারা ভুল ভাবছে। কারণ একজন বীর পতিত হলে শত বীর সেই পতাকা তুলে নেবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইনি। এই বিষয়ে আমাদের অবস্থান আগেও ছিল, এখনো আছে। আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং তা আন্তর্জাতিক আইন মেনেই পরিচালিত হচ্ছে।”
পেজেশকিয়ান জানান, তার সরকার এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনায় আগ্রহী। তিনি বলেন, “আমরা এখনো সংলাপের পথ বন্ধ করে দিইনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আমরা দায়িত্বশীল আচরণ করছি। কেউ যেন আমাদের শান্তিপূর্ণ মনোভাবকে দুর্বলতা মনে না করে।”
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে একতরফাভাবে সরে যায়। এরপর থেকেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ভাষণে বলেন, “আমরা আগ্রাসন শুরু করিনি, আমাদের মাটিতে আগুন বর্ষণ করা হয়েছে। আমাদের লোকজন, নারী-শিশু—নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছেন। এখন সময় এসেছে সবাইকে একত্র হয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।”
তিনি আহ্বান জানান, ইরানের সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী যেন একসঙ্গে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়। তার ভাষায়, “আমরা ভিন্ন মত পোষণ করতে পারি, কিন্তু যখন দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে, তখন সবাইকে এক পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
গত শুক্রবার ভোর রাতে ইসরায়েল ইরানের অন্তত তিনটি সামরিক ও একটি বেসামরিক পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। ইরানের দাবি, এসব স্থাপনা ছিল শান্তিপূর্ণ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র। জবাবে ইরান মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলে ডজনখানেক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যাতে প্রাণ হারায় ১৮ জন ইসরায়েলি নাগরিক।
এই পাল্টাপাল্টি হামলায় একদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে আইএইএ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মধ্যস্থতার আহ্বান জানাচ্ছে।
ইরানের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যকে একদিকে যেমন সাহসী রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে, অন্যদিকে অনেকে এটিকে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলায় একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও ব্যাখ্যা করছেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, “পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার ঘোষণা যদিও ইতিবাচক বার্তা দেয়, তবে ভবিষ্যতের কার্যক্রম দিয়েই ইরানকে তার প্রতিশ্রুতি প্রমাণ করতে হবে। কারণ বর্তমানে ইরান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ সীমিত করেছে।”
তবে তেহরানের এই অবস্থান স্পষ্টভাবে পশ্চিমা বিশ্বকে বার্তা দিচ্ছে যে, ইরান যুদ্ধ নয়, সংলাপের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চায়—যদিও প্রতিরোধে প্রস্তুত।
মধ্যপ্রাচ্যে যখন আবারও এক নতুন সংঘাতের স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে, তখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি আন্তর্জাতিক শান্তিকামী শক্তিগুলোর জন্য আশাব্যঞ্জক বার্তা হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, এই সংকট কূটনৈতিক আলোচনার পথে এগোয়, নাকি আরও ভয়াবহ সংঘর্ষের দিকে গড়ায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ