
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের একটি বা একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলি বিমান হামলার প্রেক্ষিতে আজ সোমবার জরুরি বৈঠকে বসছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা—আইএইএ (International Atomic Energy Agency)। সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ড অব গভর্নরসের এই বিশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভিয়েনায় সংস্থার সদর দপ্তরে।
বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের পারমাণবিক উত্তেজনার মোড় ঘোরানো এই মুহূর্তে বৈঠকটি শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ইরানের অনুরোধে, রাশিয়া, চীন ও ভেনেজুয়েলার কূটনৈতিক সমর্থনে এই বৈঠক ডাকা হয়েছে। সূত্র: বিবিসি।
আইএইএর বৈঠকে মূল আলোচ্য ইস্যু—ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে চালানো সামরিক হামলা। ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করেছে, আইএইএর বোর্ড অব গভর্নরদের উচিত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানানো এবং ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করা।
তেহরান বলছে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমাবর্ষণ আন্তর্জাতিক নীতিমালার চরম লঙ্ঘন। এটি শুধু ইরানের সার্বভৌমত্বেই হস্তক্ষেপ নয়, বরং গোটা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কাঠামোর জন্য এক অশনি সংকেত।
প্রাথমিকভাবে ইরান চাইছিল, ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে আইএইএর পক্ষ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হোক এবং ভোটাভুটির মাধ্যমে তা গৃহীত হোক। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ৩৫ সদস্যের বোর্ডে এ ধরনের একটি প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলেই ধারণা। ফলে ইরান এখন একটি অপেক্ষাকৃত নরম অবস্থান নিয়েছে—একটি সাধারণ বিবৃতি বা “Chair’s Summary Statement” গৃহীত হোক, যেখানে অন্তত ইসরায়েলের হামলাকে অগ্রহণযোগ্য বলা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈঠকের তাৎপর্য শুধু একদিনের আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের কয়েকটি বিষয় নির্ধারিত হতে পারে:
আইএইএর মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কীভাবে সংঘর্ষপূর্ণ পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে।
শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে কতটা প্রভাবিত হয়।
অস্ট্রিয়ায় নিযুক্ত এক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষক বলেন, “এই বৈঠকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণ না হলেও, এটি ইসরায়েল ও ইরানের পারমাণবিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিভঙ্গির দিকনির্দেশনা দিতে পারে।”
তেহরান থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইরান এখনো দ্ব্যর্থহীনভাবে দাবি করছে, ইসরায়েলের এই হামলা যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। তবে আইএইএর বৈঠকে তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে কোনো ধরনের সাময়িক যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। বরং এই বৈঠক অনেকটাই প্রতীকী এবং নীতিগত আলোচনার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে হতে পারে, যা একটি ভিন্ন পরিসর এবং কূটনৈতিক কাঠামোর বিষয়।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—এই চারটি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি কোনো প্রকাশ্য সমর্থন না দিলেও, আইএইএর বোর্ডে তারা ইরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের দিকেই অবস্থান নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, রাশিয়া, চীন ও ভেনেজুয়েলা ইরানকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে বলছে—আন্তর্জাতিক আইন ও শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির নিরাপত্তার স্বার্থেই এই ইস্যুতে জোরালো অবস্থান নিতে হবে।
জাতিসংঘ সনদ, ১৯৭০ সালের পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (NPT) এবং ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো দেশের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। আইএইএর তত্ত্বাবধানে থাকা স্থাপনায় হামলা হলে সেটি সংস্থার নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত বলে গণ্য হয়।
তবে বাস্তবে এই আইন প্রয়োগ অনেকটাই রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোটের প্রভাব থাকায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
আজকের বৈঠকটি পারমাণবিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির বর্তমান অবস্থার একটি সংবেদনশীল পরীক্ষা। ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে আইএইএর অবস্থান কতটা নিরপেক্ষ ও কঠোর হয়, তা শুধু ইরান নয়, গোটা বিশ্ব পরমাণু ব্যবস্থাপনাই নিবিড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হলেও এই বৈঠক মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ উত্তেজনা কমাতে কিছুটা হলেও দিকনির্দেশক ভূমিকা রাখতে পারে, এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ