
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে বহুদিন ধরে চলমান উত্তেজনা এবার রূপ নিয়েছে সরাসরি সামরিক সংঘাতে। শুক্রবার ইসরাইলের আকস্মিক ও গোপন অভিযানের পর ইরান যে পাল্টা জবাব দেবে, তা অনুমান করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। তবে হামলার মাত্রা ও গভীরতা দেখে হতবিহবল হয়ে পড়েছে ইসরাইল। বিশেষত রাজধানী তেল আবিবে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর শহরের চিত্রই পাল্টে গেছে। আতঙ্কিত নাগরিকেরা ছুটে গেছেন ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে, ধ্বংসস্তূপে উদ্ধারকারী দল কাজ করছে রাত-দিন, এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকেও ব্যক্তিগত কর্মসূচি বাতিল করতে হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের জেরুজালেম প্রতিনিধি জেরেমি ডায়মন্ড সরেজমিনে তেল আবিবের রাস্তায় গিয়ে দেখেছেন ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আবাসিক ভবনে আঘাত হেনেছে। ডায়মন্ডের ভাষায়, “যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার কাছেই একটি বহুতল আবাসিক ভবনের একটি অংশ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। কয়েক ব্লক দূর থেকেই ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে। উদ্ধারকারী ও সামরিক কর্মীরা ধ্বংসস্তূপে তল্লাশি চালাচ্ছেন। এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের গর্তগুলো থেকে।”
এই হামলার পর অন্তত ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের সন্ধানে কাজ করছেন সেনাবাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরাও। আহতদের অনেকেই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ছিটকে পড়ে বা ভবনের ধ্বংসাবশেষে আটকে পড়ায় আহত হয়েছেন।
সিএনএনের প্রতিবেদনে এক নারী বাসিন্দার অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে, যিনি বলেন, “আমরা আমার বাড়ির বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলাম। উপরে কী হচ্ছে, টের পাচ্ছিলাম। নিচেও কম্পন হচ্ছিল, শব্দ হচ্ছিল—এমন জোরে যে মনে হচ্ছিল দেয়াল ভেঙে পড়বে। পরে উপরে এসে দেখি চারপাশ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি এবং আমার স্বামী সাবধানে বের হই, কিন্তু চারপাশে ভবন ধসে পড়ছিল। বাতাসে ধোঁয়া, ধুলা আর পোড়া কিছু একটা গন্ধে নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। টি-শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁটতে হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মতো অনেকেই বেসমেন্টে ছিল। কেউ কেউ বাচ্চাসহ নেমে গিয়েছিল। আমরা ভাগ্যবান যে সময়মতো নিচে যেতে পেরেছিলাম, না হলে বাঁচা যেত না।”
তেল আবিবের পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন রাতভর হাই অ্যালার্টে রয়েছে। ইরান থেকে হামলার পূর্বাভাস পাওয়ার পর পরই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং নাগরিকদের সতর্ক করা হয়।
জেরেমি ডায়মন্ড জানান, “যাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, সবাই কোনো না কোনো ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন হামলার সময়। সেই কারণেই প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তারা। কারণ এই হামলা ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তেল আবিবে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।”
তাঁর মতে, “সেই সময় ইরাকে থাকা সাদ্দাম হোসেন স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরাইল আক্রমণ করেছিল, কিন্তু এবার ইরান অত্যাধুনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে—যার ধ্বংসক্ষমতা অনেক বেশি। যদি আগে থেকে সতর্কতা না থাকত, তাহলে হতাহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হতে পারত।”
এই হামলার পর বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরাইলের বিখ্যাত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’-এর কার্যকারিতা নিয়ে। তেল আবিবের বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের বেশ কয়েকটি আয়রন ডোম ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। যদিও ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি, তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা—এই প্রযুক্তিগত সাফল্য ইরানের কৌশলগত অগ্রগতি নির্দেশ করে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যেগুলোর গতিপথ ও আঘাতের কোণ আয়রন ডোমের রাডার সহজে ধরতে পারে না। তাছাড়া তারা ডামি ও মূল ক্ষেপণাস্ত্র একসঙ্গে পাঠিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করেছে।
ইরানি হামলার পর শুধু তেল আবিব নয়, আশপাশের অনেক শহরে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। বেশিরভাগ পরিবার খাবার পানি, শুকনা খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ শহর ছেড়ে গ্রামীণ এলাকায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন।
এই পরিস্থিতির কারণে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজ ছেলের বিয়ের দিনক্ষণ পেছাতে বাধ্য হয়েছেন। রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে এই হামলা নিয়ে চলছে জোর আলোচনার পাশাপাশি পাল্টা জবাবের প্রস্তুতিও।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরান ও ইসরাইলের এই সরাসরি সংঘাত শুধু দু’দেশ নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। দুই দেশের কোনো একটি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া এই যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিতে পারে আরও বিস্তৃত আকারে—যা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইল, বিশেষ করে তেল আবিব যে পরিমাণ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, তা দেশটির নাগরিকদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসে বড় ধাক্কা দিয়েছে। সারা শহরজুড়ে আতঙ্ক, ধ্বংস এবং অনিশ্চয়তার এক বাস্তব চিত্র তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে জেগে উঠেছে এক নতুন প্রশ্ন—সামরিক দম্ভ কি সত্যিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, নাকি সেটাই ডেকে আনে বড় বিপর্যয়?
বাংলাবার্তা/এমএইচ