
ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক অস্থিরতা, দীর্ঘস্থায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক মন্দার অভিঘাত—সব কিছু মোকাবিলা করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। চলতি অর্থবছরের ১৪ জুন পর্যন্ত যেভাবে পণ্য হ্যান্ডলিং ও জাহাজ আগমনের পরিসংখ্যান জমা হয়েছে, তাতে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডলিং করা হয়েছে প্রায় ৩১ লাখ ৬৩ হাজার কনটেইনার এবং প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মেট্রিক টন কার্গো। পাশাপাশি, পণ্য পরিবহনকারী প্রায় ৪ হাজার জাহাজ ভিড়েছে বন্দরে। এ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বন্দর কর্তৃপক্ষ সাড়ে ৩২ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাইলফলকে পৌঁছাবে বলে আশাবাদী।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সূচনালগ্নে রাজনৈতিক অস্থিরতা এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের যে ব্যাপক আন্দোলন চলেছিল জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে, তা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ছিল ব্যাহত।
এরপর সেপ্টেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেয়। নদীবিধৌত দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা নামে। এ তিন মাসে বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, রফতানি-আমদানি, জাহাজ আগমনসহ সব সূচকেই ছিল চরম মন্দা।
তবে অক্টোবর মাসে এসে পরিস্থিতির劇 নাটকীয় উন্নয়ন ঘটে। প্রধান রাজনৈতিক দলের আন্দোলন স্থগিত হওয়া, প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা এবং জলাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বন্দর ফের প্রাণ ফিরে পায়। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প ও অন্যান্য রফতানিমুখী খাত তাদের কার্যক্রম আগের ছন্দে ফিরিয়ে আনে।
বন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অক্টোবরের পর থেকেই বন্দর অভ্যন্তরে প্রতিদিন কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দ্রুত বাড়তে থাকে। এ পর্যন্ত ৩১ লাখ ৬৩ হাজার কনটেইনার এবং সাড়ে ১২ কোটি মেট্রিক টন কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯.৭ শতাংশ বেশি। আর চলতি সময়েই বন্দরে ৩ হাজার ৯০০টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বন্দরের ধারাবাহিক সংস্কার কর্মসূচি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা। বন্দরের সদস্য (হারবার অ্যান্ড মেরিন) ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আবদুল্লাহ বলেন, “আমরা গত কয়েক বছরে ক্রমাগত যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, জেটি সম্প্রসারণ ও ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়েছি। যার ফলে এখন আমরা বেশি জাহাজ দ্রুত খালাস করতে পারছি। এছাড়া আমদানি-রপ্তানির গতি বেড়েছে এবং ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরেছে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমের সিংহভাগই সম্পন্ন হয় বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বা অফডকে। চলতি অর্থবছরে ২১টি অফডকে হ্যান্ডলিং করা হয়েছে রেকর্ডসংখ্যক ৬ লাখ ৮৮ হাজার রফতানি কনটেইনার এবং ২ লাখ ৫৪ হাজার আমদানি কনটেইনার। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব বলেন, “প্রায় পুরো রফতানি কার্যক্রম এখন আমাদের মাধ্যমেই হয়। আমাদের সক্ষমতা ও সেবা মান বৃদ্ধির কারণেই দেশের রফতানিতে এই প্রবৃদ্ধি এসেছে। এটা কেবল বন্দরের জন্য নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর।”
চট্টগ্রাম বন্দরের এই রেকর্ড সাফল্যের বড় একটি অংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাতের কার্যক্রম থেকে। গার্মেন্টস শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও তাঁরা রফতানির ধারা ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। বিজিএমইএ পরিচালক এমডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমরা কোনো অজুহাতে চলতে পারি না। এজন্য আমাদের সবাইকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়েছে। শ্রমিক থেকে শুরু করে মালিকপক্ষ—সবাই মিলে এই অর্জনের ভাগীদার।”
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই মার্চ পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যার বড় অংশই ছিল তৈরি পোশাক। একইসঙ্গে দেশে আসা কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও উৎপাদন উপকরণের একটি বিরাট অংশ বন্দরের মাধ্যমেই এসেছে।
বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও বাড়ছে। বিশ্বখ্যাত লয়'ড লিস্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১০০টি ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৬৭তম। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় এই স্থান নির্ধারণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী কয়েক বছরে কর্ণফুলী নদীর নতুন টার্মিনাল ও বে-টার্মিনাল চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান আরও উপরের দিকে উঠবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. নাসির উদ্দীন জানান, “আমরা বন্দর ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি, সম্পূর্ণ ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম এবং পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করছি। পাশাপাশি, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জেটি সম্প্রসারণ ও গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পও এগিয়ে চলেছে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুটা যতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, বছর শেষটা ততটাই আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য। অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়—সব ক্ষেত্রেই এই বন্দরের ভূমিকা অপরিসীম। চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই আগের সব রেকর্ড ভেঙে নতুন ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। সংকটের মধ্যেও এই সফলতা দেশের অর্থনীতির প্রতিরোধক্ষমতা ও সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ