
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা এবং সাম্প্রতিক সময়ের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাবলী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চীন ও রাশিয়া, যাদের ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাদের অবস্থান নিয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সতর্কতামূলক। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরাইলের অব্যাহত হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে উত্তেজনা কমানোর জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছে যে, এই সংঘাত দ্রুত বড় কোনো বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিতে পারে, যার ভয়াবহ প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়বে।
চীন বারবার ইসরাইল ও ইরানকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা অবিলম্বে এমন পদক্ষেপ নেয় যা উত্তেজনা কমাবে এবং এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া থেকে রক্ষা করবে।” তিনি আরও যোগ করেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি এবং চীন গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে আগ্রহী।
২০২৪ সালের অক্টোবরেও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ানোর বা সংঘাত সৃষ্টির যে কোনো প্রয়াসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একই মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনায় বলেন, “এ ধরনের অব্যাহত যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা অঞ্চলটির জন্য কোন লাভ নেই।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, সব পক্ষ নিজেদের দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে কাজ করবে যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়।
বিশ্ব পারমাণবিক তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা (IAEA) এর বোর্ড অব গভর্নরসের ২০২৫ সালের ১২ জুনের এক ভোটে চীন ও রাশিয়া ইরানের বিরুদ্ধে আনা একটি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ওই প্রস্তাবে অভিযোগ ছিল ইরান তার পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, “এই সংকট সৃষ্টি করেছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়া।” তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবরোধ, চাপ ও শক্তির হুমকি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সিনা ওয়েইবোতে ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ হাজার হাজার বার দেখা হচ্ছে এবং হাজার হাজার মন্তব্য পোস্ট করা হচ্ছে। চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত টিভি চ্যানেল সিসিটিভি সরাসরি ওয়েইবোতে এই সংঘাতের খবর সম্প্রচার করছে।
একজন প্রভাবশালী ভাষ্যকার হু শিজিন উল্লেখ করেছেন, ইসরাইল মোসাদ দ্বারা ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে হত্যা করেছে, যা তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে অভিহিত করেন। অন্য এক ভাষ্যকার ইরানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশ্ন তোলেন যে, ইসরাইল কোনোভাবে ইরানের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে জড়িত কি না।
এছাড়া জাতীয়তাবাদী ব্লগাররা ইসরাইলের শক্তির সামনে নতজানু হওয়া অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন এবং বলেছেন, “সত্য কেবল লোহার মুষ্টির নিচে থাকে” — যা বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির নির্মম বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনগুলো ইসরাইলের ইরান হামলা নিয়ে সরাসরি কোনো বড় প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে তারা উল্লেখ করেছে যে, ইসরাইল শুধুমাত্র পারমাণবিক স্থাপনা নয়, আবাসিক এলাকা পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও বেসামরিক লোকজনও হতাহত হয়েছে, তবে হামলা প্রধানত ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর লক্ষ্য রাখে।
রাশিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রো-ক্রেমলিন ভাষ্যকার সার্গেই মার্কভ বলেন, “রাশিয়া ইরানের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র, কিন্তু সামরিক মিত্র নয়।” তিনি যোগ করেন, “রাশিয়ার প্রধান ভূমিকা হবে রাজনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতা, সামরিক পর্যায়ে নয়।” একই রকম মত পোষণ করেছেন রাশিয়ার চ্যানেল ওয়ানের উপস্থাপক আরতিয়ম শেইনিন, যিনি বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি খুবই অনিশ্চিত।”
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে সামরিক সহযোগিতার বিষয় রয়েছে, তবে এপ্রিল মাসে রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুডেনকো স্পষ্ট করে বলেছেন, “যদি ইরান যুদ্ধে জড়ায়, রাশিয়া বাধ্য হয়ে সামরিক সহায়তা দেবে না।”
বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান বেশ সতর্ক ও কূটনৈতিক। তারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধবিরোধী হলেও, মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সমঝোতা ও আলোচনার পথ সুগম করার চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলে বড় ধরনের সামরিক সংঘাত বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে তারা বারংবার সতর্ক করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও চীন ও রাশিয়া ইরানের রাজনৈতিক ও কৌশলগত মিত্র, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা। তাদের যেকোনো পদক্ষেপ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট দ্রুত উত্তেজনায় না গড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের উত্তেজনার মাঝে চীন ও রাশিয়া নিজেদের অবস্থানকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে এবং সামরিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে কূটনৈতিক সমাধান ও শান্তির আহ্বানকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা ইরানের পাশে আছে, তবুও তারা সামরিক লড়াই এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে সকল পক্ষকে আনার চেষ্টা করছে। এই সংকট দ্রুত মিটিয়ে বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা ফিরে আসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ