
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অপরাধ পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসেই দেশে মোট ১,৫৮৭টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩২২টি, যা প্রায় ২০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ, গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যেখানে ১,২৬৫টি হত্যা মামলা ছিল, সেখানে এবার গড়ে প্রতি মাসে ৩১৭টি হত্যা মামলার ঘটনা ঘটেছে।
দিনে গড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং আইনের শাসনের প্রতি আস্থা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে প্রতি মাসেই হত্যার সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানুয়ারি মাসে মোট ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারি ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি, এপ্রিলে ৩৩৬টি এবং মে মাসে ৩৪১টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে হত্যার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৩১, ২৪০, ২৩৯, ২৯৬ ও ২৫৯টি।
প্রতি মাসে গড়ে ৬৬ জন বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন, যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বিরাট সতর্কবার্তা।
হত্যার পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় কারণ কাজ করছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ৪৭ জন, আর এপ্রিল ও মে মাসে ২০ জন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
এই সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির বিশ্লেষকরা আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিশোধ, চাঁদাবাজি ও প্রতিষ্ঠানের দখল নিয়ে সংঘর্ষকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম তিন মাসের ৩২৫টি রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে ১৯০টি সংঘর্ষ বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘটিত হয়েছে।
মোট রাজনৈতিক হত্যা যেটা প্রথম পাঁচ মাসে ঘটেছে, তাতে বিএনপির নেতাকর্মী নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক—৪৫ জন। এছাড়া, আওয়ামী লীগের ১০ জন, জামায়াতের একজন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একজন এবং ইউপিডিএফের দুইজন নিহত হয়েছেন।
রাজধানীতে রাজনৈতিক খুনের পরিমাণ বেশি, যেখানে পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়, গত পাঁচ মাসে ঢাকা রেঞ্জে ৩৭৬টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ২৯৯টির তুলনায় অনেক বেশি। রাজধানীতে রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হত্যার পরিমাণ মোট হত্যার ৩৯ শতাংশ।
রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু হত্যাকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, এতে অন্তত ৭০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং প্রায় চার শতাধিক বাড়িঘর, রাজনৈতিক কার্যালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের শিকার হয়েছে।
গণপিটুনির ঘটনাতেও গত পাঁচ মাসে ৫৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে এইচআরএসএস জানিয়েছে, যা সামাজিক অস্থিরতার আরেক দিক।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় হত্যার ঘটনা অনেক বেশি। চলতি বছরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসে ময়মনসিংহে ৪৪টি, কুমিল্লায় ৪২টি, সিরাজগঞ্জে ৩৮টি, নারায়ণগঞ্জে ৩১টি এবং ঝিনাইদহে ২৯টি হত্যা হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, যশোর, নওগাঁ, ফরিদপুর, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নাটোর, বরিশাল, শরীয়তপুর, বাগেরহাট, খাগড়াছড়ি, জয়পুরহাট, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, বরগুনা, জামালপুর, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর ও রাঙামাটিতে বিভিন্ন মাত্রায় হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
সম্প্রতি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শঙ্করপুরে পারিবারিক কলহ থেকে এক কৃষককে কোদালের আঘাতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যশোরের অভয়নগর উপজেলায় কুয়েতফেরত এক যুবককে জবাই করে হত্যা করা হয়। বগুড়ায় স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে অস্বীকার করায় রিকশাচালক বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাজধানীতেও একের পর এক নির্মম খুনের ঘটনা ঘটছে, যেমন দক্ষিণখানে এক নারীকে প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা এবং পল্লবী ও কমলাপুরে কয়েকজন দম্পতির বাসায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানিয়েছেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তৎপর রয়েছে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এসব হত্যা ও অপরাধ ঘটছে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, পুলিশকে মাঠে আরও সক্রিয় হতে হবে যাতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কমানো যায়।
গত রবিবার সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক কোর কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চলছে এবং পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, অপরাধের ওঠানামা থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধীদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত আছে।
দেশের নিত্যদিনের সংবাদপত্রের পাতা ভরে যাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের খবর দিয়ে, যা দেশের মানুষের নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্য গুরুতর হুমকি। সরকারের উচিত দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর ভূমিকা পালন করা এবং রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি অসম্ভব। তাই এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ