
ছবি: সংগৃহীত
বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পেছনে যেসব প্রশাসনিক ও নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৭ জুন (সোমবার) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এই বৈঠকে মূলত নির্বাচন কমিশন সংস্কার ও জুলাই সনদের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হলেও, বৈঠকের একপর্যায়ে অতীতের নির্বাচন নিয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। এতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বলেন, “যেসব কর্মকর্তার ভূমিকা নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তাদের আইনি ও নৈতিকভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। দায়িত্বশীল পদে থেকে যাঁরা ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছেন, তাঁদের দায় অস্বীকার করা যাবে না।”
এ প্রেক্ষিতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িত প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট সচিবদের দায়িত্ব ও ভূমিকা তদন্তে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন ড. ইউনূস।
বৈঠকে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “বেশকিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। আমরা জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। খুব শিগগিরই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে এটি প্রকাশযোগ্য অবস্থায় আসবে।”
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন যারা পরিচালনা করেছেন, তাদের কার্যকলাপ তদন্ত করে প্রামাণ্য দলিল তৈরি করতে হবে। জনগণের মধ্যে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে হলে দোষীদের জবাবদিহির মুখোমুখি করতেই হবে।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যেসব নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেসবের দায় নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ঘাড়ে না দিলে ভবিষ্যতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে না।”
বৈঠকে লন্ডন সফর শেষে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “লন্ডনে যেখানেই গেছি, সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন এসেছে ভোটাধিকার নিয়ে—তারা জানতে চেয়েছেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো?’”
তিনি বলেন, “এই আগ্রহকে সম্মান জানিয়ে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট বা ইলেকট্রনিক ভোটিংসহ যেসব সম্ভাব্য ব্যবস্থা আছে, তা নিয়ে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আগামী নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি হবে জাতির আস্থা পুনর্গঠনের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেজন্য প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জুলাই মাসের মধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ, গ্রহণযোগ্য ও সম্মিলিত ঐকমত্য সনদ জাতির সামনে উপস্থাপন করা যাবে। এই সনদে থাকবে নির্বাচন কমিশন গঠনের নীতিমালা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও আচরণবিধি, সেনাবাহিনীর ভূমিকা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার স্পষ্ট রূপরেখা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে শুধু একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে এটি একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক বার্তা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের তিনটি জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন, বিক্ষোভ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তার উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হলো এবার।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে গঠিত এই কমিটি কেবল দায়িত্ব নিরূপণ করেই থেমে থাকবে না—তারা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক, সাংবিধানিক ও আইনি সুপারিশও করবে বলে বৈঠকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এর ফলে একদা নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবান নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও প্রথমবারের মতো জবাবদিহির মুখোমুখি হতে পারেন। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন সংস্কার যাত্রায় এক যুগান্তকারী মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ