
ছবি: সংগৃহীত
ঈদ উৎসব স্বাভাবিকভাবেই আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের প্রতীক। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানা রকম স্বাদের বাহারি খাবারের উৎসবও। কুরবানির ঈদ মানেই বাড়ে মাংসের ব্যবহার, বিশেষ করে গরু বা খাসির মাংস থেকে তৈরি বিভিন্ন ঝাল-বাটা, ভুনা, কাবাব, নেহারি, পায়েস, জিলাপি ইত্যাদি মুখরোচক পদার্থ। যদিও এই খাদ্যগুলো ঈদের আনন্দ বাড়ায়, তবুও অনেকেই ঈদের পরই হজম সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাসিডিটি, গ্যাস ও ওজন বৃদ্ধি সহ নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতার শিকার হন। এর পেছনে রয়েছে খাদ্যাভ্যাসে হঠাৎ ও ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ।
আজকের লেখায় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো কেন ঈদের পর হজম সমস্যা হয়, কী কারণে শরীরের বিপাকীয় ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়, কী ধরনের ডায়েট হজমে সহায়ক, এবং কীভাবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে সহজেই এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ঈদের পর হজম সমস্যা কেন হয়?
ঈদে খাওয়া-দাওয়ার স্বাভাবিক ধারা একেবারে পাল্টে যায়। বিশেষ করে মাংস ও উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবারের অতিরিক্ত সেবন হজম প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এর পেছনে মূল কারণগুলো হলো:
১. হাই প্রোটিন ইনটেক
গরু বা খাসির মাংস প্রোটিনে সমৃদ্ধ হলেও অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ হজম এনজাইমের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। এতে ডায়রিয়া, বমিভাব, গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডিটির মতো সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত মাংস কম খান, তারা ঈদের সময় হঠাৎ অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীর মানিয়ে নিতে পারে না।
২. উচ্চ চর্বি ও তেলের অতিরিক্ত ব্যবহার
ঈদের সময় ভাজাপোড়া, ঘি-মাখানো পদ বা বেশি তেল-মসলাযুক্ত খাবারের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে পিত্তরস নিঃসরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যা ধীর হজম এবং ফ্যাটি লিভারসহ বিভিন্ন পেটের সমস্যার সূত্রপাত ঘটায়। কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
৩. আঁশ জাতীয় খাদ্যের অভাব
ঈদের খাবারে শাক-সবজি ও ফলের তুলনায় বেশি হয় মাংস ও মিষ্টিজাতীয় খাবার, যেখানে আঁশের পরিমাণ কম থাকে। আঁশ শরীরের হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং মলত্যাগকে নিয়মিত রাখে। এই আঁশের অভাবে হজমে জটিলতা হয়।
৪. হাই গ্লাইসেমিক ডেজার্টের প্রভাব
ঈদে পায়েস, জিলাপি, সেমাই, কেকের মতো মিষ্টিজাতীয় খাবারের আধিক্য রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও অতিরিক্ত চিনি হজমে ব্যাঘাত ঘটায়।
ঈদের পর সুস্থ হজমের জন্য ডায়েট পরিকল্পনা
ঈদের পরপরই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে ধীরে ধীরে ফিরে আসা জরুরি। এক্ষেত্রে ‘ডায়েট রিস্টোরেশন উইক’ বা খাদ্য পুনরুদ্ধার সপ্তাহ হিসেবে অন্তত ৭-১০ দিন সচেতন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর ও সহজপাচ্য খাদ্যের মাধ্যমে হজম ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব।
১. ধাপে ধাপে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
শরীর স্বাভাবিকভাবে ‘হোমিওস্টেসিস’ নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়। তাই হঠাৎ করে অতিরিক্ত কঠোর ডায়েট না নিয়ে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যকর খাদ্যে ফিরতে হবে।
সকালের নাশতায় ওটস, কলা, চিয়া সিডসসহ হালকা ও আঁশযুক্ত খাবার
দুপুরে মাছের ঝোল, ব্রাউন রাইস বা লাল চাল ও শাকসবজি
রাতে হালকা ডাল, সবজি স্যুপ, সালাদ
২. আঁশ ও প্রোবায়োটিকের গুরুত্ব
আঁশ (ফাইবার) পেট পরিষ্কার রাখে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। অন্তত ২৫-৩০ গ্রাম আঁশ দৈনিক গ্রহণ করা উচিত।
প্রোবায়োটিক যেমন দই, লাচ্ছি, কেফির অন্ত্রের ভাল ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে হজমে সাহায্য করে।
৩. পর্যাপ্ত পানি পান
পানি অন্ত্রে সহজ গতি বজায় রাখে, ডিহাইড্রেশন কমায়। কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান জরুরি। ডাবের পানি, পাতলা লাচ্ছি, ফলের জুস বা ডিটক্স পানি (আদা, পুদিনা দিয়ে) ভালো বিকল্প।
৪. হালকা ব্যায়াম
দিনে ৩০ মিনিট হাঁটা, স্ট্রেচিং বা হালকা জগিং মেটাবলিজম বাড়ায়, হজমের গতি বাড়ায় ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
আইডিয়াল ঈদের পর ডায়েট প্ল্যান (উদাহরণস্বরূপ)
সকাল: ১ গ্লাস কুশুম গরম পানি লেবুর সাথে + ওটস/লাল আটার রুটি + সেদ্ধ ডিম + ফল
দুপুর: লাল চাল/ওটস ভাত + রান্না করা মাছ বা মুরগির স্যুপ + শাকসবজি + ডাল
বিকাল: ফলের সালাদ + দইয়ের লাচ্ছি বা গ্রিন টি
রাত: মিক্সড সবজি স্যুপ + হালকা ডাল-ভাত বা ওটস
হজম সমস্যা এড়াতে কি কি থেকে বিরত থাকা উচিত?
অতিরিক্ত মাংস একটানা ৩ দিনের বেশি খাওয়া থেকে বিরত থাকা
ঠান্ডা ও কার্বনেটেড পানীয় (সফট ড্রিঙ্ক) পরিহার করা
অতিরিক্ত ভাজা ও ঝাল খাবার এড়িয়ে চলা
দেরিতে বা রাতে খাবার খাওয়ার অভ্যাস বন্ধ করা
অতিরিক্ত চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য কম খাওয়া
ঈদের পর খাদ্যাভ্যাসের মানসিক প্রভাব
অনেকে ঈদের পর ‘গিল্ট ইটিং’ বা অপরাধবোধে ডায়েট শুরু করেন, আবার কেউ কেউ একেবারে না খেয়ে যান, যা হজমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর পরিবর্তে ধাপে ধাপে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে ফিরে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিশেষ স্বাস্থ্যকর পরামর্শ
খাবার ধীরে ধীরে, ভালোভাবে চিবিয়ে খান
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান
পানি বেশি পান করুন, বিশেষ করে গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে
প্রোবায়োটিক খাবার নিয়মিত খান
বেশি তেল-মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন
খাবারের পর অন্তত ১৫-২০ মিনিট হালকা হাঁটুন
পুদিনা, আদা, জিরা পানি হজমে সহায়ক
মানসিক চাপ কমান, কারণ স্ট্রেস হজমে সমস্যা তৈরি করে
প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং পুষ্টিবিদের সাহায্য নিন
ঈদ উৎসব যেমন আনন্দ ও উদযাপনের সময়, তেমনি এটি খাদ্যাভ্যাসের বড় পরিবর্তনেরও সময়। তাই ঈদের পর স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি, যাতে শরীরের হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে এবং স্বাস্থ্যরক্ষায় কোনও বাধা না আসে। পুষ্টিকর, সহজপাচ্য খাদ্য, পর্যাপ্ত পানি ও নিয়মিত ব্যায়াম এই সমাধানের মূল চাবিকাঠি। ঈদ একটি সময়ের জন্য, কিন্তু স্বাস্থ্য সারা বছর ধরে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রেখে সুস্থ থাকাই হলো ঈদের পর সেরা উপহার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ