
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে—জ্বালানি নিরাপত্তা ও বায়ুর মান উন্নয়নের জন্য মোট ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। এই অর্থায়ন দেশের টেকসই উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সংস্থাটির বোর্ড বুধবার এই ঋণ অনুমোদন দেয় এবং বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বিশ্বব্যাংকের এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে একদিকে যেমন গ্যাস সরবরাহের নিরাপত্তা বাড়বে, অন্যদিকে বায়ু দূষণ হ্রাসে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। এ দুই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রথম প্রকল্পটি, যার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার, সেটি ‘জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি’ প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন হবে। এই প্রকল্পের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল ও গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলাকে সাশ্রয়ী মূল্যে অর্থায়নের সুযোগ প্রদান করা হবে, যা তাকে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরও উন্নত ও নিরাপদ করতে সহায়তা করবে।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) গ্যারান্টি ব্যবহৃত হবে, যার মাধ্যমে আগামী সাত বছরের মধ্যে প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বেসরকারি মূলধন সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। এই গ্যারান্টি পেট্রোবাংলার ঋণগ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করবে এবং দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সক্ষমতা নিশ্চিত করবে। বর্তমানে গ্যাস সরবরাহে যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি পূরণ করতে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, “বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও বায়ু মান উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অগ্রাধিকার। গ্যাস সরবরাহ সীমাবদ্ধতা এবং নগর বায়ু দূষণের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এ দুটি প্রকল্প বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অভিযাত্রায় গতি আনবে।”
দ্বিতীয় প্রকল্পটির নাম ‘বাংলাদেশ ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট’, যার আওতায় ২৯ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো বায়ু দূষণ মোকাবেলায় একটি সমন্বিত ও টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করা। বর্তমানে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিবেশবিদদের মতে, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর দেশে ১ লাখ ৫৯ হাজারেরও বেশি মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। শুধু তাই নয়, দূষণজনিত রোগের কারণে ২৫০ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়, যার ফলে স্বাস্থ্য ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় জিডিপির প্রায় ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার নাম দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার তুলনায় ঢাকার বাতাসে সূক্ষ্ম কণার (PM2.5) পরিমাণ ১৮ গুণ বেশি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রকল্পটি পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্ককে আধুনিক ও কার্যকরভাবে সাজাবে। নতুন নতুন মনিটরিং স্টেশন স্থাপন ছাড়াও পুরনো স্টেশনগুলো উন্নত করা হবে, যা দেশের নানা অঞ্চলে দূষণের মাত্রা নির্ণয় এবং নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দুটি প্রকল্পই বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে। জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হবে, যার ফলে শিল্প উৎপাদন বাড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। অন্যদিকে বায়ু দূষণ কমে গেলে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমবে এবং মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়বে।
বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের ঋণ প্রকল্পগুলো সাধারণত স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে প্রদান করা হয়, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্থায়নের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে অবশ্যই প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সময়ানুবর্তিতা বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের ঋণ ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের এ ৬৪ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন শুধু দুটি প্রকল্প নয়, বরং বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শনের প্রতিফলন। জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবেশ রক্ষা—দুটি খাতই দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। উন্নত ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়তে এ ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
এই দুই প্রকল্প যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের নগরজীবন ও অর্থনীতি দুটোতেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ