
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে শৃঙ্খলা পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে একযোগে পাঁচজন সচিব এবং একজন গ্রেড-১ পদমর্যাদার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) রাতে এ সংক্রান্ত পৃথক ছয়টি প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ২৫ বছর চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়া কর্মকর্তাদের সরকার ‘কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই’ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারে।
এই ধারা প্রয়োগ করে যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনায় জড়িত ছিলেন। এ সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যেসব কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, তারা হলেন—
কাজী এনামুল হাসান: বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন।
সুকেশ কুমার সরকার: জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির (এনএপিডি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
মুহম্মদ ইব্রাহিম: ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
ড. মো. সহিদ উল্যাহ: জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির (নায়াড) রেক্টর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন: ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পদে কর্মরত সচিব ছিলেন।
ড. লিপিকা ভদ্র: বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান, যিনি গ্রেড-১ কর্মকর্তার মর্যাদাভুক্ত।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী এই কর্মকর্তারা বাধ্যতামূলক অবসরের পর তাদের পদের জন্য নির্ধারিত যাবতীয় আর্থিক ও অবসর-জনিত সুবিধা পাবেন।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ নম্বর ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী যদি ২৫ বছর বা তার অধিক সময় চাকরিতে কর্মরত থাকেন, তাহলে সরকার জনস্বার্থে তাকে অবসরে পাঠাতে পারে, এবং এজন্য আলাদা করে কোনো কারণ দর্শানোর প্রয়োজন নেই।
এই ধারাটি প্রয়োগ করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অতীতে বেশ কয়েকবার কর্মকর্তা অবসরে পাঠানো হয়েছে। বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্বল পারফরম্যান্স, প্রশাসনিক অসঙ্গতি, রাজনৈতিক পক্ষপাত কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তারা এই ধারায় অবসরে পাঠানো হয়েছেন বলে বিভিন্ন সময় গুঞ্জন উঠেছে। যদিও সরকার কখনোই নির্দিষ্ট অভিযোগ প্রকাশ করে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই কয়েকজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, যাদের অনেকেই আগে থেকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একসঙ্গে ছয়জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো একটি শক্ত বার্তা—সরকার প্রশাসনের কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কঠোর হতে চলেছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে যেসব কর্মকর্তা আলোচনায় ছিলেন, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে নানা কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বা অবসরে পাঠানো হয়েছে।
বর্তমান সময়ের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস রাজনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দল বা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশাসনে যেসব কর্মকর্তা সুবিধাভোগী ছিলেন বলে ধারণা করা হয়, তাদের অনেকেই এখন সidelined হচ্ছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইছে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও পেশাদারিত্বভিত্তিক কাঠামোয় পুনর্গঠিত করতে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও সতর্কতা ও আত্মবিশ্লেষণের প্রবণতা দেখা দিতে পারে, কারণ এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন যে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করলেও সরকারের আস্থা হারালে যে কেউ চাকরি হারাতে পারেন।
এর আগে চলতি বছরেই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকজন সচিব ও অতিরিক্ত সচিবকে একই আইনের আওতায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। তখনও প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল।
একই ধারা প্রয়োগ করে অতীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছিল। তবে এবার একসঙ্গে ছয়জনকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি সাম্প্রতিক কালের মধ্যে অন্যতম বড় প্রশাসনিক রদবদল।
একসঙ্গে পাঁচজন সচিব এবং একজন গ্রেড-১ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কর্মক্ষমতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস বলেও অভিহিত করা যেতে পারে।
তবে এই ধরনের পদক্ষেপ যেন শুধুই প্রতীকী না হয়ে পড়ে, বরং দীর্ঘমেয়াদে প্রশাসনের কাঠামো ও সংস্কৃতিতে যে স্থায়ী ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন, সেটির দিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে কেবল শীর্ষ পর্যায়ে নয়, নিচের স্তরগুলোতেও কর্মদক্ষতা যাচাই, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ