
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত "সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)" ২০২৪-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন দেশের প্রশাসনিক দুর্নীতির একটি বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপ অনুসারে, গত এক বছরে সরকারি সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশকে ঘুস দিতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি তিনজন নাগরিকের একজন সরকারি সেবা পেতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস অডিটোরিয়ামে এই জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সভাপতিত্ব করেন বিবিএস-এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. কাইয়ুম আরা বেগম এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। সার্ভে প্রকল্পের পরিচালক রাশেদ-ই-মাসতাহাব প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালনা করেন যুগ্মসচিব দীপঙ্কর রায়।
সিপিএস জরিপের তথ্যে সরকারি বিভিন্ন সেবা খাতে দুর্নীতির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উঠে এসেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), যেখানে সেবা নিতে আসা নাগরিকদের ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৬১.৯৪%), তৃতীয় পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%), এবং চতুর্থ ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস (৫৪.৯২%)।
লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুরুষদের মধ্যে ঘুস-দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বেশি (৩৮.৬২%)। নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ২২.৭১%। এটি পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে পুরুষরাই সেবা ব্যবস্থায় বেশি জড়িত এবং সম্ভবত তারা প্রশাসনিক দুর্নীতির মুখোমুখি হওয়ায় সংখ্যাগতভাবে এগিয়ে।
জরিপে দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবোধ সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরা করতে ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক নিরাপদ বোধ করেন। তবে পুরুষদের (৮৯.৫৩%) তুলনায় নারীরা (৮০.৬৭%) কিছুটা কম নিরাপদ বোধ করেন। শহরাঞ্চলে নিরাপত্তাবোধের হার (৮৩.৭৫%) গ্রামাঞ্চলের (৮৫.৩০%) চেয়ে সামান্য কম।
জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশের ১৯.৩১ শতাংশ জনগণ কোনো না কোনো বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীদের মধ্যে এই হার ১৯.৬২ শতাংশ, যা পুরুষদের তুলনায় (১৮.৯৭ শতাংশ) সামান্য বেশি। শহরাঞ্চলে বৈষম্যের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় স্পষ্টভাবে বেশি—২২.০১ শতাংশ বনাম ১৮.০৭ শতাংশ। বৈষম্য বা হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে নিজের পরিবারের মধ্যে (৪৮.৪৪%), গণপরিবহণ বা উন্মুক্ত স্থানে (৩১.৩০%), এবং কর্মস্থলে (২৫.৯৭%)। অথচ এর মধ্যে মাত্র ৫.৩৫ শতাংশ ভুক্তভোগী বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করেছেন।
জরিপে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ ও প্রভাব সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধিও উঠে এসেছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ মনে করেন তারা সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন। বিপরীতে ৭২ দশমিক ৭৬ শতাংশ মনে করেন, তারা কোনো ধরনের মত প্রকাশ করতে পারেন না। একইভাবে, মাত্র ২১.৯৯ শতাংশ মনে করেন তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো ধরনের প্রভাব রাখতে পারেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার ২৬.৫৫% এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১৭.৮%।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৪৭.১২ শতাংশ নাগরিক গত এক বছরে অন্তত একবার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ৮২.৭২ শতাংশের মতে, সেবাটি সহজে প্রাপ্য এবং ব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে ছিল। শিক্ষা ক্ষেত্রে ৪০.৯৩ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি শিশু সরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। নাগরিক নিবন্ধন বা পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য সেবা গ্রহণে ৭৮.১২ শতাংশ নাগরিক বলেছে সেবাটি সহজে পাওয়া যায় এবং ৮৬.২৮ শতাংশ বলেছে ব্যয়টি তাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল।
গত দুই বছরে ১৬.১৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধ বা বিবাদের মুখোমুখি হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৩.৬০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার আওতায় বিচার পেয়েছেন। এর মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার পাওয়ার একটি ইতিবাচক চিত্র ফুটে ওঠে, যদিও বিরোধের উৎস এবং নিষ্পত্তির মান নিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি।
প্রধান অতিথি ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি শুধু প্রশাসনে নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও কম হচ্ছে না। শিক্ষক বদলি নিয়েও ঘুস বাণিজ্যের বাস্তব চিত্র তিনি তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির চক্র এতটাই গভীর যে প্রকৃত অপরাধীকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া, তিনি ধর্মভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে জরিপে ইতিবাচক ফলাফলের প্রশংসা করেন।
বিবিএস পরিচালিত এই সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে দেশের নাগরিক জীবনের বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জের একটি অনন্য দলিল। ঘুস, দুর্নীতি, বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা ও মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা আমাদের প্রশাসনিক ও সামাজিক কাঠামোর গভীর সংকট নির্দেশ করে। জরিপ থেকে পাওয়া এই তথ্যকে শুধু পরিসংখ্যান মনে না করে, সরকার ও সমাজের কাছে এটি হওয়া উচিত আত্মসমালোচনার একটি সুযোগ এবং সংস্কারের একটি প্রেরণা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ