
ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের প্রমাণ মিলছে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ তদন্তে। ব্যাংক লুট, দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া এই অর্থ যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, জার্সি, আইল অফ ম্যানসহ বিভিন্ন ট্যাক্স হ্যাভেন দেশ ও অঞ্চলে পাচার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি, ফ্ল্যাট, কোম্পানি ও বিভিন্ন ব্যবসা। সরকারের একাধিক সংস্থা ইতোমধ্যে এই সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
বিশেষত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের একাধিক সদস্য ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির নাম এ তদন্তে উঠে এসেছে। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার বাড়ি, মেয়ে এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট শনাক্ত করা হয়েছে। তদুপরি শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অফশোর বিনিয়োগ সম্পর্কেও অনুসন্ধান চলছে।
শুধু রাজনীতিক নন, আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন এই তালিকায়। যেমন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান এবং ভাতিজা শাহরিয়ার রহমানের নামে যুক্তরাজ্যে দুটি বিলাসবহুল বাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য ৭৭ লাখ পাউন্ড, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,৩০০ কোটি টাকা।
আবার সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের নামে ৩৩৬টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট এবং ব্যাংকে ৩৫ কোটি টাকা জমার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোর বাজারমূল্য ১,২৫০ কোটি টাকার বেশি। শুধু তার নয়, তার ভাই রনি চৌধুরীর নামেও যুক্তরাজ্যে হাউজিং ব্যবসা ও একাধিক সম্পদের সন্ধান মিলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা শাখা সিআইসি (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল), বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের সিআইডি ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (NCA), ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (IACCC), এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যৌথভাবে এ তদন্তে অংশ নিচ্ছে।
সিআইসির একটি দল সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করে বাংলাদেশি বিভিন্ন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর নামে সম্পদের সন্ধান সংগ্রহ করেছে। এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাসা গ্রুপের মত আলোচিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। নাসা গ্রুপের নামে যুক্তরাজ্যে পাঁচটি এবং আইল অফ ম্যান ও জার্সিতে আরও দুটি সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর দলিল মূল্য ৬৪৫ কোটি টাকার বেশি হলেও বাজারমূল্য কয়েকগুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষভাবে নজরকাড়া তথ্য হলো, যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম এবং তার স্বামী তৌহিদুল ইসলামের নামেও লন্ডনে সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আবদুল মোতালিব যুক্তরাজ্যে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিককে—যার বর্তমান মূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি। আবদুল মোতালিবের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাউজিং ব্যবসা ও একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনার তথ্যও সামনে এসেছে।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এখনো পর্যন্ত তার নামেই কোনো স্থাবর সম্পদের অস্তিত্ব মেলেনি, তবে বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির মালিকানা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্রার্কলেস ব্যাংকে খোলা দুটি ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের বিষয়ে তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ।
এই তদন্তে উঠে আসা আরেকটি বিস্ফোরক তথ্য হলো, একটি বাংলাদেশি শিল্প গ্রুপ যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানির ৬ লাখ ২৭ হাজার শেয়ার কিনেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০২ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ কীভাবে করা হয়েছে, অর্থের উৎস কী, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
এ পর্যন্ত তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাদের সম্পদ জব্দ হয়েছে। আরও বহু ব্যক্তি ও পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অন্যান্য সংস্থা বলছে, ২০০ কোটি টাকার বেশি পাচার করে যুক্তরাজ্যে যাদের সম্পদ গড়ে উঠেছে, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। ধীরে ধীরে আরও অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
এই তদন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় অর্থপাচার ও দুর্নীতির চিত্র উন্মোচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। একদিকে যেমন অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় এর প্রভাব ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ