
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করা ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের স্মরণে ৫ আগস্টকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশের জাতীয় ক্যালেন্ডারে যুক্ত হতে যাচ্ছে একটি নতুন দিবস—‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন দিবস’, যা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে প্রথমবারের মতো।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা ও খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
তিনি বলেন, “এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ এবং ছাত্রসমাজ একাত্ম হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক অবস্থান নিয়েছিল, সেটি কেবল রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও আমাদের জাতিসত্তার গভীরে গেঁথে গেছে। তাই ৫ আগস্ট এখন থেকে সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হবে এবং এটি জাতীয় দিবসের মর্যাদা পাবে।”
উপদেষ্টা ফারুকী জানান, ৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে এক মাসব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নানা আয়োজন, আলোচনা, চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক উৎসব। মূল আয়োজন শুরু হবে ১৪ জুলাই থেকে এবং চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত।
তিনি বলেন, “এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা শুধু অতীত স্মরণ করব না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা দেব—অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পক্ষে আমাদের অবস্থান অবিচল। আন্দোলনে যেভাবে গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, কর্মসূচিও সেভাবেই সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন হবে।”
এই ছুটির চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে আগামী রবিবার (২২ জুন)। সেদিন অনুষ্ঠিত হবে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ বৈঠক, যেখানে ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন দিবস’কে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা ও রাষ্ট্রীয় গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
ফারুকী বলেন, “এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি তারিখ নির্ধারণ নয়, এটি একটি মূল্যবোধের ঘোষণাও। রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, কখনো কখনো নাগরিকদের আত্মদানের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র তার বিবেক ফিরে পায়। ৫ আগস্ট সে রকম একটি দিন।”
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, যা ২০২৫ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস জুড়ে সংঘটিত হয়, সে সময়কার রাজনৈতিক স্থবিরতা, কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও গণবিচ্ছিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে এক গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা, যাদের নেতৃত্বে রাজপথে নামে লাখো মানুষ।
এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পাশাপাশি একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, যার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার নতুন ভিত্তি স্থাপিত হয়। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, ব্যানার, মিছিল এবং ‘স্বাধীনতার পরবর্তী বৃহত্তম জন-আন্দোলন’ হিসেবে এই অভ্যুত্থান ইতিহাসে স্থান পায়।
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৫ আগস্ট থেকে শুরু করে প্রতিবার এই দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হবে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে দিবসটি উপলক্ষে থাকবে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আন্দোলনের ইতিহাসভিত্তিক নাট্য ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনাসভা।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘আন্দোলনের শিক্ষা ও মূল্যবোধ’ শীর্ষক আলোচনা আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, “আমরা কেবল ছুটি ঘোষণা করতে চাই না, আমরা চাই সেই দিনটি হোক আত্মজিজ্ঞাসার একটি দিন, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতে পারে—একটি জাতি কীভাবে নিজের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করতে পারে। আমাদের সংস্কৃতির ভেতরে প্রতিরোধের বীজ রয়েছে। সেই বীজকে পুষে রাখতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “৫ আগস্টকে আমরা ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলন দিবস’ হিসেবে পালন করব, কারণ এই দিনেই এক অভূতপূর্ব ঐক্যের মধ্যে দিয়ে জাতি তার শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিল। এটি একটি প্রতিরোধের দিন, এটি একটি জেগে ওঠার দিন।”
৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে সরকার যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতীয় দিবস ঘোষণার পথে এগোচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে ইতিহাস, জনআন্দোলন ও গণতন্ত্রের প্রতি এক গভীর সম্মান প্রদর্শনের প্রতিফলন। এই দিবস এখন থেকে শুধু ছুটি নয়, বরং স্মরণ, সচেতনতা এবং সামষ্টিক পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইতিহাসের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংলাপ স্থাপনের এ ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘদিনের শূন্যতা পূরণ করবে এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এখন দেখার বিষয়, এই উদ্যোগ কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং সমাজে তার কতটা প্রভাব পড়ে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ