
ফাইল ছবি
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, শিক্ষা এবং গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখা চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার ২০২৫’। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম চূড়ান্ত করে বুধবার (১৮ জুন) মন্ত্রণালয় এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
এটি দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতিগুলোর একটি। এই পুরস্কারের মধ্য দিয়ে বন্যপ্রাণী রক্ষায় দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় থাকা গবেষক, সমাজকর্মী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিশ্রমকে স্বীকৃতি জানানো হয়।
চারটি বিভাগে সম্মাননা
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার চারটি ক্যাটাগরিতে দেওয়া হচ্ছে—ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’ এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ‘বন্যপ্রাণীবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা’।
১. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (ব্যক্তি পর্যায়)
এই বিভাগে পুরস্কার পাচ্ছেন নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার পূর্ব মাধনগরের মো. ফজলে রাব্বী। স্থানীয়ভাবে পরিচিত এই পরিবেশপ্রেমী দীর্ঘদিন ধরে তার এলাকায় পাখি, হরিণ, গুইসাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছেন। তিনি একা হাতে তৈরি করেছেন একটি ছোটখাটো নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যেখানে আহত বন্যপ্রাণীদের চিকিৎসা ও পরিচর্যা দেওয়া হয়।
তার উদ্যোগে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, এবং এখন পাখি শিকার বা বনজ প্রাণী নিধনের প্রবণতা অনেক কমে গেছে বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।
২. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (প্রতিষ্ঠান পর্যায়)
এই ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছে শেরপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত ‘শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি’। এই সংগঠনটি বিশেষভাবে পাখি সংরক্ষণে নিবেদিত। তারা দীর্ঘদিন ধরে শেরপুর ও আশপাশের এলাকায় পাখির আবাসস্থল রক্ষায় কাজ করছে।
এই সংগঠনটি শুধু সংরক্ষণেই নয়, পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করেছে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পাখি ও বন্যপ্রাণী রক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
৩. বন্যপ্রাণীবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা (ব্যক্তি পর্যায়)
এই বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেন। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য জরিপ, হুমকির মুখে থাকা প্রাণীর আবাসস্থল চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ কৌশল নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তাঁর গবেষণার একটি বড় অংশ কচ্ছপ, উভচর প্রাণী ও বিরল স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও অবদান রেখেছে।
৪. বন্যপ্রাণীবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা (প্রতিষ্ঠান পর্যায়)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এই বিভাগে সম্মাননা পাচ্ছে। পুরস্কার গ্রহণ করবেন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোসা. শেফালী বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ গত কয়েক দশক ধরে দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
তারা দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী জরিপ, শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়ে পাঠদান, ও গবেষণাপত্র প্রকাশের মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য তুলে এনেছে। বিশেষ করে সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে তাদের কাজ প্রশংসনীয়।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি শ্রেণির বিজয়ীকে দেওয়া হবে ২২ ক্যারেট মানের দুই ভরি ওজনের স্বর্ণপদক (২৩.৩২ গ্রাম), এক লাখ টাকার অ্যাকাউন্ট-পেয়ি চেক এবং একটি সম্মাননা সনদ। পুরস্কারটি শুধু আর্থিক সম্মাননাই নয়, এটি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় জাতীয়ভাবে বিশেষ অবদান রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা চাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যারা নীরবে কাজ করছেন, তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়ে আমরা তাদের উৎসাহিত করতে চাই। আগামী দিনে আরও বড় পরিসরে এই উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়া হবে।”
এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে একটি শক্ত বার্তা দেওয়া হয়েছে—পরিবেশ রক্ষা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই প্রকৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।
পুরস্কারপ্রাপ্তরা শুধু নিজেদের কাজের স্বীকৃতি পেলেন না, তারা হয়ে উঠলেন দেশের কোটি মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তরুণ প্রজন্মও যাতে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসে, সেটাই সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এই প্রাপ্তি যেমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্মান, তেমনি তা দেশের সার্বিক পরিবেশ আন্দোলনের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ