
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ঘিরে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন এবার আরও ভয়াবহ মোড় নিতে চলেছে। একদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আল্টিমেটাম দিচ্ছেন, অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ইরানি জাতি কখনোই মাথা নত করবে না।’ দুই পক্ষের এই বাকযুদ্ধ এখন সামরিক সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে খামেনির কঠিন মন্তব্যের জবাবে ট্রাম্প কটাক্ষ করে বলেন, ‘গুড লাক।’ বুধবার (১৮ জুন) রাতে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা প্রকাশের পরপরই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় ওঠে।
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “ইরান এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে তারা একঘরে। যদি তারা আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে তাদের জন্য আমি কেবল শুভকামনাই জানাতে পারি—গুড লাক!”
তিনি আরও বলেন, “আমার ধৈর্য প্রায় শেষ। আমি হামলা করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি। কেউ জানে না আমি কী করব। আমি চাই ইরান শেষ মুহূর্তে হলেও যুক্তিবোধ দেখাক।”
এই বক্তব্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখার পাশাপাশি সম্ভাব্য সামরিক হামলার রাস্তাও উন্মুক্ত রেখেছেন।
ট্রাম্পের দাবির ঠিক আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তার দেশের অবস্থান অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “এই জাতি কখনোই মাথা নত করবে না। আত্মসমর্পণ শব্দটি আমাদের অভিধানে নেই। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস নয়।”
খামেনি ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন, “আমেরিকা যেন ভুলে না যায়—যদি তারা ইরানে হামলা করে, তাহলে এমন প্রতিশোধ আসবে যার ক্ষতি তারা কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না।”
এই প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে খামেনি কেবল ইরানের অবস্থান নয়, বরং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যেরও বার্তা দিয়েছেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এই কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে।
তৃতীয় একটি নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন করা হয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে।
দ্বিতীয় একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ আরব সাগরের দিকে রওনা হয়েছে।
যদিও মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন দাবি করছে, এসব মোতায়েন প্রতিরক্ষামূলক, তবে সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ মূলত আক্রমণাত্মক প্রস্তুতির অংশ এবং তা ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল।
বিশ্লেষকেরা আরও ধারণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তা হবে ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বিতভাবে। কারণ, ইসরায়েল ইতোমধ্যেই ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে।
ইরানে ইসরাইলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৪৫০ ছাড়িয়েছে।
অপরদিকে, ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরাইলে প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ২৪ জনের।
এই পাল্টাপাল্টি হামলা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা আরও গভীর করছে এবং তার পরিণতি হতে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এক ভয়াবহ সামরিক সংঘাত।
ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা এখনও ইরানের সঙ্গে একটি চূড়ান্ত সমঝোতার আশা করছেন। তবে ইরান যদি আত্মসমর্পণ না করে কিংবা কোনো অর্থবহ আলোচনায় না আসে, সেক্ষেত্রে সামরিক পদক্ষেপের বিকল্প থাকবে না।
এক উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ট্রাম্প চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে ইরানের উপর। তারা যদি এখনো সময়ের মূল্য না বোঝে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।”
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইউএন মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেন, “উভয়পক্ষকে সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানাই। যুদ্ধ শুরু করা সহজ, কিন্তু বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কোনো সামরিক সংঘর্ষ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আয়াতুল্লাহ খামেনির সাম্প্রতিক বক্তব্য পরস্পরের প্রতি রাজনৈতিক কটাক্ষ এবং চূড়ান্ত অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ‘গুড লাক’ বললেও আসলে ট্রাম্প একরকম হুমকিই দিয়েছেন। এর জবাবে খামেনির অটল মনোভাব দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করেছে।
এখন বিশ্ব অপেক্ষায় আছে—এই উত্তেজনা কোথায় গিয়ে থামে? কূটনীতির টেবিলে, না যুদ্ধের ময়দানে? বিশ্ব রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এটি হতে পারে আরেকটি সন্ধিক্ষণের সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ