
ছবি: সংগৃহীত
প্রায় দেড় দশকের প্রবাসজীবনের ইতি টানতে চলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলীয় সূত্র জানায়, তিনি খুব শিগগিরই দেশে ফিরছেন। আর দেশে ফিরে রাজধানীর অভিজাত গুলশান-২ এলাকার ১৯৬ নম্বর বাড়িটিতেই উঠবেন তিনি, যেটি এক সময় তাঁর মা, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১৯৮১ সালে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর।
এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি আবাসস্থলে প্রত্যাবর্তনের বিষয় নয়—বরং এটি এক প্রতীকী বার্তা, যা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থায়ীভাবে পুনরাগমন এবং আসন্ন নির্বাচনের জন্য দলের সাংগঠনিক সক্রিয়তায় নতুন গতি আনবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সরকার গুলশান-২ এর ১৯৬ নম্বর প্লট বরাদ্দ দেয়। দেড় বিঘার এই জমির ওপর নির্মিত বাড়িটিতে খালেদা জিয়ার পরিবার বসবাস শুরু করে। পরবর্তী কয়েক দশকে বাড়িটি হয়ে ওঠে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু।
এ বাড়ির পাশেই অবস্থিত ফিরোজা নামের ভাড়া বাসায় ২০১২ সাল থেকে বসবাস করছেন বেগম জিয়া, যেটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের নীরব সাক্ষী। এখন, দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তাঁর বড় ছেলে এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সেই ঐতিহাসিক ঠিকানাতেই ফিরছেন, যা তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণেরও ইঙ্গিত বহন করে।
জুন মাসের ৪ তারিখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গুলশান-২ এর ১৯৬ নম্বর বাড়িটির নামজারি সম্পন্ন করে কাগজপত্র তুলে দেয় বেগম খালেদা জিয়ার হাতে। এর পর থেকেই শুরু হয় বাড়ির সংস্কারকাজ। তিন শোবার ঘর, ড্রয়িং ও ডাইনিং রুম, লিভিং স্পেস, সুইমিংপুল, বাগান এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা—সবকিছু নতুন করে গুছিয়ে তোলা হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ছয় মাস ধরে সংস্কার কার্যক্রম চলেছে। বাড়িটির নিরাপত্তায় এখন নিয়োজিত আছেন ১০ জন পুলিশ সদস্য। ইতোমধ্যে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানও বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। এতে করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—এই বাড়িটিই হতে যাচ্ছে তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের মূল ভিত্তি।
রাজধানীর ব্যস্ত ও কংক্রিটে ভরা পরিবেশের মাঝেই গুলশান-২ এর এই বাড়িটি যেন একটি নির্মল নিঃশ্বাস। সাদা রঙের একতলা এই বাড়িটি নানা জাতের গাছগাছালিতে ঘেরা। সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘ মেহগনিগাছগুলো যেমন ছায়া দেয়, তেমনি বাড়িটিকে রাখে শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এক নির্জন স্থানে। বাড়ির ভেতরেও রয়েছে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ।
এই সবুজ পরিবেশ শুধু শারীরিক প্রশান্তিই নয়, বরং দীর্ঘদিনের নির্বাসন থেকে ফেরা একজন রাজনৈতিক নেতার মানসিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে বলে ধারণা রাজনৈতিক মহলের।
তাঁর এই প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির এক নতুন মোড় নেওয়ার আলামত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তারেক রহমান নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হচ্ছেন। গুলশানের বাড়িটিতে বসবাস শুরু করার অর্থ হলো, বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে এবং গুলশান কেন্দ্রিক একটি হাইকম্যান্ড কাঠামো গড়ে উঠবে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির জন্য এই প্রত্যাবর্তন একটি সংগঠনিক চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ—দুইই বয়ে আনবে। বহুদিন লন্ডন থেকে দূর-নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি করার পর এবার মাঠে নেমে নেতৃত্ব দেওয়া হলে বিএনপির ওপর কর্মী-সমর্থকদের আস্থা বাড়বে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে আদালতের নির্দেশে বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয় ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে। এটি নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছিল। পরে তিনি কিছুদিন ভাইয়ের বাসায় থাকার পর ২০১২ সালের ২১ এপ্রিল থেকে গুলশানের ফিরোজা ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন।
আর এখন, একটি নতুন রাজনৈতিক পরিবেশে, মায়ের নামে বরাদ্দ পাওয়া একটি বাড়িতে ফিরে আসছেন তারেক রহমান। যা অনেকের চোখে রাজনৈতিক প্রতীকী পুনরাবৃত্তি।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপরই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তাঁর ফেরা মানে দলের পূর্ণাঙ্গ কার্যনির্বাহী নেতৃত্বের সক্রিয়তা, যা বিএনপিকে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নতুন গতিতে এগিয়ে নিতে পারে। অনেকের বিশ্বাস, দীর্ঘদিন ধরে যিনি লন্ডন থেকে দল চালিয়েছেন, এবার সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বিএনপিকে একটি কাঠামোগত ও কৌশলগত পুনর্জাগরণে নিয়ে যাবেন।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং গুলশানের ঐতিহাসিক বাড়িতে ওঠার ঘটনাটি শুধুই একটি আবাসিক বদল নয়—এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা, এক দীর্ঘ নির্বাসনের সমাপ্তি, এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ