
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনীতির মঞ্চে এখন চলছে এক অভূতপূর্ব ও বহুস্তরীয় সংঘাত। সামরিক হামলা, সাইবার যুদ্ধ, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৌশলগত মনস্তাত্ত্বিক চাপ—সব মিলিয়ে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে ইরান ও ইসরায়েলের বিরোধ। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সরাসরি মন্তব্য নতুন করে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এই প্রতিবেদনে বুধবার সকাল পর্যন্ত সংঘাত পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হলো।
ট্রাম্প-খামেনি মুখোমুখি: ডিজিটাল যুদ্ধের সূচনা
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি বিস্ফোরক পোস্ট দেন, যেখানে তিনি সরাসরি হুমকি দেন খামেনিকে। ট্রাম্প লেখেন: “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করো! আমরা ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। আমরা জানি খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন, তবে এখনই তাকে হত্যা করা হবে না। আমাদের ধৈর্য দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।”
এই বার্তাকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা স্পষ্ট যুদ্ধ-হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিশেষ করে ইরানের শীর্ষ নেতাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ট্রাম্প এক নতুন উত্তেজনার জন্ম দিলেন।
এর জবাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ একাধিক ভাষায় ধারাবাহিকভাবে পোস্ট দেন। তিনি লিখেন: “আমরা জায়নিস্টদের সঙ্গে কোনো আপস করবো না। যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দয়া দেখানো হবে না।”
খামেনির বক্তব্যে স্পষ্ট—ইরান এখন আর প্রতিরোধ নয়, আক্রমণাত্মক কৌশলে যাচ্ছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতির সর্বশেষ আপডেট (বুধবার সকাল পর্যন্ত):
◼ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রস্তুতি:
বুধবার ভোররাতে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্স লেকেনহিথ ঘাঁটি থেকে অন্তত চারটি এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান আকাশে উড়তে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ফ্লাইটগুলো মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথের দিকে যাচ্ছে, যা ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণের ইঙ্গিত দিতে পারে।
◼ মোসাদ সদরদপ্তরে হামলার দাবি:
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসনিম প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর সদরদপ্তরে আগুন জ্বলছে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড (IRGC) দাবি করছে, এটি তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফল।
◼ ইরানি জেনারেল নিহত:
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আইডিএফ মঙ্গলবার রাতে দাবি করে, তারা ইরানের জেনারেল আলী শাদমানিকে লক্ষ্য করে সফল হামলা চালিয়েছে। যদিও ইরান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই হত্যাকাণ্ড নিশ্চিত করেনি।
◼ ইসরায়েল: সরকার পতন নয়, পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংসই লক্ষ্য:
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদোন সা’আর স্পষ্টভাবে জানান, “ইরানের সরকার বদল নয়, বরং তাদের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।”
◼ প্রাণহানির হিসাব:
ইরানের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস ইন ইরান (HRANA) জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সংঘাতে ৪৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক।
এই তথ্য ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।
পরমাণু স্থাপনাগুলোতে হামলার আশঙ্কা
জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা IAEA বলছে, তারা নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ অংশে আক্রমণের সম্ভাব্য প্রভাব দেখতে পেয়েছে।
তবে ইসফাহান বা ফর্দো প্ল্যান্টে এখনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি চোখে পড়েনি। তবুও মধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ভয়ংকর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পাল্টা হামলায় ইসরায়েলি ঘাঁটিতে আঘাত
ইরানের ফারস নিউজ এজেন্সি দাবি করেছে, ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত মেরন বিমানঘাঁটিতে তারা হামলা চালিয়েছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পাল্টা হামলায় ৫০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে বলে দাবি করে আইডিএফ।
এর ফলে চলমান সংঘাত এখন সম্পূর্ণ সামরিক যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে।
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ফাত্তাহ-১’ ব্যবহারের দাবি
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড মঙ্গলবার রাতেই জানায়, তারা ইসরায়েলের দিকে ‘ফাত্তাহ-১’ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র মাচ ১৩ (ধ্বনির চেয়ে ১৩ গুণ দ্রুত) গতি সম্পন্ন, এবং বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য অস্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বন্ধ: উদ্বেগের বার্তা
ইসরায়েলের জেরুজালেমে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তিন দিনের জন্য (বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত) বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ: বিশ্বের সামনে আরও একটি বড় যুদ্ধ?
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান ও ইসরায়েল বর্তমানে একটি "প্রক্সি সীমারেখা" পেরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। যদিও দুই পক্ষই এখনও ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধ’ ঘোষণায় বিরত রয়েছে, তবে বাস্তবতা বলছে, এই সংঘাত একাধিক মহাদেশে বিস্তৃত একটি সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে।
বিশ্ব শক্তিগুলোর এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে তেল সরবরাহ, পরমাণু নিরাপত্তা ও মানবিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ চরমে পৌঁছেছে।
সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, তাসনিম, HRANA, IAEA, ফারস নিউজ, ট্রুথ সোশ্যাল, এক্স (সাবেক টুইটার)
বাংলাবার্তা/এমএইচ