
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের মধ্যে থাকা ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর ক্রমশ বাড়ছে চাপ। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র ও সাম্প্রতিক এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ইরানের ধারাবাহিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে ইসরাইলের ইন্টারসেপ্টর মজুদের পরিমাণ এখন তীব্র সংকটে পড়েছে। এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশটি হয়তো আর মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন এই প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে—এমন সতর্কতাও উচ্চারিত হচ্ছে।
যুদ্ধের মধ্যে চাপের মুখে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের (WSJ) এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে এক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে ‘বড় সাফল্য’ দাবি করলেও বাস্তবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, দেশটির বহুল প্রশংসিত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ইন্টারসেপ্টর—বিশেষ করে অ্যারো সিস্টেম—প্রতিদিন বিপুল হারে ব্যবহার হওয়ায় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে মজুদ।
এই প্রতিবেদনটি এমন এক সময় সামনে এল, যখন ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি এবং ঘন ঘন ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় চলছে। ইসরাইল গত সপ্তাহে শুরু করেছিল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের একটি বড় সামরিক অভিযান। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান গত কয়েক দিনে প্রায় ৪০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইসরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে।
ইসরাইল দাবি করছে, তাদের বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে বেশিরভাগ প্রজেক্টাইল ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং, অ্যারো সিস্টেম, এবং মার্কিন সহায়তায় প্রাপ্ত প্যাট্রিয়ট ও থাড সিস্টেম। তবে এই প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে প্রতিদিন যে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা এখন ইসরাইলের জন্য রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিরাতে শত শত মিলিয়ন ডলারের খরচ
ইসরাইলের অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা ‘দ্য মার্কার’-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কেবলমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় ইসরাইলের প্রতিদিন গড়ে ২৮৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল হচ্ছে অ্যারো সিস্টেম, যা প্রতি ইন্টারসেপ্টরে গড়ে ৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে।
অর্থাৎ, ইরানের প্রতিটি হামলা ঠেকাতে ইসরাইলকে দিতে হচ্ছে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ। যদি প্রতিদিনের ব্যবহৃত ইন্টারসেপ্টরের সংখ্যা কয়েক ডজন হয়, তাহলে শুধু একটি সিস্টেম ব্যবহার করেই দিনে ১০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি খরচ হয়ে যাচ্ছে—যা দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মজুদ কমছে, টিকে থাকার দিন গোনা শুরু
মার্কিন ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুসারে, ইসরাইল ইতোমধ্যেই ইরানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকারী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে বলে দাবি করছে। তেল আবিবের কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা এখন ইরানের আকাশের ওপর ‘আংশিক শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জন করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শ্রেষ্ঠত্ব হয়তো খুব বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না, কারণ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদের অর্ধেকের বেশি এখনও অক্ষত, এবং এগুলোর অনেকাংশ ভূগর্ভস্থ গোপন ঘাঁটিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
এসব কারণে, ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সরবরাহ দ্রুত না বাড়ে, তাহলে আর মাত্র ১০-১২ দিনেই ইসরাইলের ইন্টারসেপ্টর মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে।
যুদ্ধ থামছে না, বরং বেড়েই চলেছে
এদিকে ইরানও থেমে নেই। ইসরাইলের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ইরান সম্প্রতি এমন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে যা ‘ক্লাস্টার বোমা’ বহন করতে সক্ষম। এই নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এটি ইসরাইলের জন্য কেবল সামরিক নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
কী হতে পারে আগামী দিনগুলোতে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে:
যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক ও কারিগরি সহায়তা আরও বাড়ানো।
বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতির পথে অগ্রসর হওয়া, যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা খুবই কঠিন।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ধ্বংসে আরও আগ্রাসী অভিযান, যা যুদ্ধকে আরও তীব্র করতে পারে।
তবে যেকোনো পথেই খরচ বিশাল, ঝুঁকি বড়। আর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ—ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ‘দম’ ফুরিয়ে এলে পুরো যুদ্ধের ভারসাম্য একেবারে ইরানের পক্ষে ঝুঁকে পড়তে পারে।
তথ্যসূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য মার্কার, রয়টার্স
বাংলাবার্তা/এমএইচ