
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল বিপ্লব ও তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট দুনিয়া। এই বিশাল ভার্চুয়াল জগতে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয় ওয়েবসাইট। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক উদ্যোগ—সবারই মুখ্য যোগাযোগ, তথ্য প্রচার ও সেবা প্রদানের মাধ্যম এখন ওয়েবসাইট। আর তাই প্রতিবছর যেভাবে নতুন ওয়েবসাইট যুক্ত হচ্ছে, তা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ডেটা অ্যানালিটিকস প্ল্যাটফর্ম ডিমান্ডসেইজ-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মোট ওয়েবসাইটের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১২ কোটি। তবে এত বিশাল সংখ্যার মধ্যে কেবল ১৭ শতাংশ ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ বা সক্রিয় রয়েছে। অর্থাৎ, বাকি ৮৩ শতাংশ ওয়েবসাইট নিষ্ক্রিয়, অচল, বা পুরোপুরি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি ইন্টারনেট ব্যবহারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরছে। ওয়েবসাইট তৈরি করা সহজ হলেও তাকে টিকিয়ে রাখা, নিয়মিত কনটেন্ট আপডেট করা এবং ব্যবহারকারীদের জন্য কার্যকর রাখা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া।
উল্লেখযোগ্য একটি তথ্য হলো—প্রতিবছর গড়ে ৮.৯ থেকে ৯ কোটি নতুন ওয়েবসাইট ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখেরও বেশি ওয়েব ঠিকানা নিবন্ধিত হচ্ছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক ওয়েবসাইটের মধ্যে প্রতিদিনই হাজার হাজার ওয়েবসাইট নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে বা মুছে যাচ্ছে।
এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—
১. ব্যবসায়িক বা প্রকল্প ব্যর্থতা
২. সাইবার নিরাপত্তা ও হ্যাকিং সমস্যায় ভুগে সাইট বন্ধ করে দেওয়া
৩. পর্যাপ্ত কনটেন্টের অভাব এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতা
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক উদ্যোক্তা বা সংস্থা ওয়েবসাইট চালু করলেও কিছুদিন পর সেটি দেখভালের অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
একটি ওয়েবসাইট কতটা সফল হবে তা নির্ভর করে ট্রাফিক সোর্স বা দর্শকদের আগমনের ওপর। ডিমান্ডসেইজ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়েবসাইটের দর্শকদের বড় অংশ আসে গুগল সার্চ, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল বিজ্ঞাপন থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎস হলো গুগল।
বর্তমানে google.com বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া ওয়েবসাইট, যার দৈনিক পেজভিউ সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার কোটি। এর পরেই আছে YouTube ও Facebook। এই তিনটি প্ল্যাটফর্ম মিলে ইন্টারনেট ট্রাফিকের বিশাল একটি অংশ নিজেদের দখলে রেখেছে। নতুন ওয়েবসাইটগুলোকে এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন (SEO), সোশ্যাল শেয়ারিং এবং ইউজার-সেন্ট্রিক কনটেন্ট তৈরির দিকে নজর দিতে হবে।
বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইল ডিভাইস থেকে ওয়েব ব্রাউজ করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখনো বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ ওয়েবসাইট মোবাইল ফ্রেন্ডলি নয়। এর ফলে ব্যবহারকারীরা ঐসব ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলেও দীর্ঘ সময় অবস্থান না করে দ্রুত বের হয়ে যান, যা ওয়েবসাইটের র্যাংকিং ও কার্যকারিতা দুইই নষ্ট করে।
ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল-ফার্স্ট ডিজাইন এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং এটি ওয়েবসাইট সফলতার বাধ্যতামূলক শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেটের পথচলার ইতিহাসও কম চমকপ্রদ নয়। ১৯৯০ সালে টিম বার্নার্স-লি বিশ্বের প্রথম ওয়েবসাইট info.cern.ch তৈরি করেন। তখন এর উদ্দেশ্য ছিল গবেষকদের জন্য তথ্য বিনিময়ের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। ১৯৯৩ সালে প্রযুক্তিটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলে শুরু হয় ওয়েবের এক বৈপ্লবিক যাত্রা।
সেই থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত ওয়েব ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে কোটি কোটি ওয়েবসাইট, সার্চ ইঞ্জিন, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ওয়েব৩ এবং ব্লকচেইনের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী দিনের ওয়েব হবে আরও বেশি ইন্টারঅ্যাকটিভ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সুরক্ষিত এবং কনটেন্ট-ভিত্তিক। কনটেন্টের মান, নিয়মিত আপডেট, ব্যবহারকারীর সাথে সম্পর্ক এবং নির্ভরযোগ্যতাই হবে ওয়েবসাইটের মূল শক্তি।
বিশ্বের প্রতিটি ওয়েবসাইট যেন হয় একটি তথ্যসংগ্রহের কার্যকর কেন্দ্রে, সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। শুধুমাত্র নতুন ডোমেইন নিবন্ধন করলেই একটি ওয়েবসাইট সফল হয় না। বরং সেটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় নিয়মিত হালনাগাদ, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা, এবং ব্যবহারকারীদের উপযোগী করে তুলতে।
যেমন গ্রন্থাগারে হাজারো বই থাকলেও পাঠকের পছন্দ ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে বইটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তেমনি ওয়েবসাইটও হারিয়ে যায় ‘ডিজিটাল ভিড়ে’।
ওয়েবসাইট এখন আর কেবল একটি ডিজিটাল উপস্থিতির নাম নয়, এটি একটি পরিচয়, তথ্যভাণ্ডার এবং প্রযুক্তিনির্ভর কার্যকারিতার প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সংখ্যার দিক থেকে আমরা এগোলেও গুণগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে।
তাই নতুন ওয়েবসাইট তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজন দায়িত্বশীল কনটেন্ট নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন আপডেট এবং ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়ামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাহলেই ইন্টারনেটের এই বিশাল গ্রন্থাগার হয়ে উঠবে সত্যিকারের জ্ঞানভিত্তিক, তথ্যনির্ভর ও মানবকেন্দ্রিক প্রযুক্তি বিশ্বের চালক শক্তি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ