
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার আলোচিত তাবেলা সিজার হত্যা মামলায় দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন এবং বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমসহ চারজনকে খালাস দিয়েছেন। আট বছর আগের এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রায়ে আদালত বলেছে, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তিন আসামিকে দণ্ড দেয়া হয়েছে, তবে বাকি চারজনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় তারা খালাস পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুল ইসলামের আদালত জনাকীর্ণ পরিবেশে এই রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘিরে আদালত এলাকায় ছিল বাড়তি নিরাপত্তা।
এই মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন: তামজিদ আহমেদ ওরফে রুবেল, রাসেল চৌধুরী এবং মিনহাজুল আরেফিন ওরফে ভাগনে রাসেল।
এই তিনজন দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে আটক ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে আদালতে দেওয়া বিভিন্ন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণের প্রমাণ উঠে আসে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি।
মামলার খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন: বিএনপির নেতা ও গুলশান থানা শাখার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুম, তার ভাই আবদুল মতিন,শাখাওয়াত হোসেন এবং সোহেল।
এই চারজনের মধ্যে কাইয়ুম ও সোহেল বিচার চলাকালীনই পলাতক ছিলেন। তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শেষ হয়। খালাস পাওয়া বাকি দুজন—মতিন ও শাখাওয়াত—বিচার চলাকালে জামিনে ছিলেন এবং আজকের রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে সন্দেহ থাকলেও অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। ফলে খালাস দেয়া হয়।
এই মামলার সূত্রপাত ঘটে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, যখন সন্ধ্যার সময় রাজধানীর গুলশান ৯০ নম্বর সড়কের পাশের ফুটপাতে দুর্বৃত্তরা ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজারকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটে গভর্নর হাউজ সংলগ্ন এলাকায়।
তাবেলা তখন নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিসিও কো-অপারেশন বাংলাদেশ (ICCO Cooperation BD)-এর আবাসিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি জিহাদি পর্যবেক্ষণ সংস্থা দাবি করে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তবে সে সময় বাংলাদেশ সরকার এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়।
এদিকে, আইসিসিও কো-অপারেশনের বাংলাদেশ আবাসিক প্রধান হেলেন দার বিক তৎকালীন গুলশান থানায় অজ্ঞাতনামা তিনজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক গোলাম রাব্বানী ২০১৬ সালের ২৮ জুন সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন, যেখানে বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের নামও যুক্ত করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল—একজন বিদেশি শ্বেতাঙ্গকে হত্যা করে দেশে-বিদেশে আতঙ্ক তৈরি করা এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
তদন্ত ও বিচার চলাকালে একাধিক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র সংগ্রহ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ঘটনাস্থল নির্ধারণের নানা দিক।
তবে এসব জবানবন্দির অধিকাংশই ছিল সহ-আসামিদের বিরুদ্ধে, এবং খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সাক্ষ্য বা প্রযুক্তিগত প্রমাণ মেলেনি বলে জানানো হয় রায়ে।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “আমরা তিনজনের বিরুদ্ধে রায় পেয়েছি। তবে যাদের খালাস দেয়া হয়েছে, আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো।” অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেন, “দীর্ঘ আট বছর পর হলেও বিচার পাওয়া গেছে। আমরা আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান জানাই। খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, এটাই আদালত স্বীকার করেছেন।”
এই হত্যাকাণ্ডের সময় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
আইএস জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা নিয়ে তখন ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। যদিও সরকার সে সময় থেকে আজ অবধি বারবার বলে আসছে—বাংলাদেশে আইএসের কোনো সাংগঠনিক অস্তিত্ব নেই, বরং এ ধরনের হামলার পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
এই মামলায় তদন্ত, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলে। মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর বিচারকাজ শুরু হয়। সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতর্ক বিশ্লেষণের পর অবশেষে আট বছর পর এই রায় দিল আদালত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রায় বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও দেশে আইনের শাসনের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। তবে মামলায় পলাতক দুই আসামিকে এখনো আইনের আওতায় আনতে না পারায় বিচার অসম্পূর্ণ থেকে গেছে বলেও অভিমত প্রকাশ করছেন অনেকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ