
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কাজা কালাসের সাম্প্রতিক মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তেহরান। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) এক টেলিযোগাযোগ বার্তায় ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পারমাণবিক আলোচনায় দীর্ঘদিনের শীর্ষ প্রতিনিধি আব্বাস আরাগচি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ‘পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা’ নিয়ে কোনো আলোচনায় ইরান অংশ নেবে না এবং এমন আলোচনা প্রস্তাবই আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অসম্মান।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ প্রতিনিধি কাজা কালাস সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, “ইরানের উচিত তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা এবং দ্রুত আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা।” তিনি জোর দিয়েছিলেন, ইরানকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতায় ফিরতে হবে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংশ্লিষ্ট রেজোলিউশনগুলোর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
তবে ইরান মনে করছে, এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA)’ এর পরিপন্থী।
এই প্রেক্ষাপটে আব্বাস আরাগচি এক্স (সাবেক টুইটার)–এ দেয়া বার্তায় তীব্র ভাষায় কালাসের মন্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “যদি জেসিপিওএ-এর সমন্বয়কারী এই বিশ্বাসে পৌঁছান যে আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা, তাহলে আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই — এটি একপাক্ষিক ও অবৈধ ধারণা।”
আরাগচি আরও বলেন, এমন অবস্থান গ্রহণের ফলে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়:
ইইউ প্রতিনিধি এনপিটি (পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) লঙ্ঘন করছেন, যেখানে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক গবেষণা, উন্নয়ন এবং ব্যবহারের অধিকার স্বীকৃত।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২২৩১ এবং জেসিপিওএ-এর নিয়মাবলী অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যার ফলে তথাকথিত ‘স্ন্যাপব্যাক’ প্রক্রিয়াও এখন ভিত্তিহীন।
ভবিষ্যতে যেকোনো আলোচনা বা সমঝোতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তার সদস্য রাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণ এখন অপ্রাসঙ্গিক এবং কার্যত মূল্যহীন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইইউ প্রতিনিধি কাজা কালাসের সাম্প্রতিক বক্তব্যে ইরানের ওপর একতরফা চাপ প্রয়োগের প্রবণতা স্পষ্ট। তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললেও, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানি পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষতির বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। এমনকি এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে — সে বিষয়েও তিনি কোনো উদ্বেগ জানাননি।
এ নিয়ে তেহরানের একাধিক সূত্র জানায়, ইইউ ও পশ্চিমা জোটের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান এবং দ্বৈত নীতির কারণেই পরমাণু ইস্যুতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। ইরান দাবি করে আসছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে শান্তিপূর্ণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার লক্ষ্যে পরিচালিত।
এদিকে সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ সামরিক ও সাইবার অভিযানের কারণে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেছে। যদিও তেহরান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এসব হামলা ইরানকে আরও আত্মনির্ভরশীল করে তুলেছে এবং পরমাণু প্রযুক্তি আরও গোপনে ও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক জেসিপিওএ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে সরে যাওয়ার পর থেকেই তেহরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। এরপর ইরান ধাপে ধাপে চুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে সরে আসতে থাকে। বর্তমানে ইরান পরমাণু সমৃদ্ধকরণের মাত্রা আন্তর্জাতিক সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানায় IAEA।
তবে তেহরান সবসময় বলেছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং প্রতিরক্ষা খাতের বাইরে। কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা তাদের নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপ যদি সত্যিই আলোচনায় বসতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই পক্ষপাতহীন অবস্থান নিতে হবে এবং ইরানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সম্মান জানাতে হবে। অন্যথায়, তেহরান যেভাবে ইউরোপকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ঘোষণা করছে, তাতে পশ্চিমা কূটনীতির প্রভাব এই অঞ্চলে ক্রমশ হ্রাস পেতে পারে।
ইরানের স্পষ্ট বার্তা — পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা নয়, বরং বৈধ অধিকার রক্ষা করাই আলোচনার ভিত্তি হতে হবে। যতক্ষণ না এই নীতিগত পার্থক্য দূর হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ