
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। চলতি জুলাই মাসের প্রথম তিন দিনেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক হাজার। শুধু গত ২৪ ঘণ্টাতেই নতুন করে আরও একজনের মৃত্যু এবং ৩৫৮ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর ফলে চলতি বছর এখন পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১১ হাজার ৪৫৬ জনে, আর মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫ জনে পৌঁছেছে।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একজন রোগী বরিশাল বিভাগে মারা যান। এ নিয়ে জুলাই মাসের প্রথম তিন দিনে টানা মৃত্যু হলো তিনজনের।
বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগেই সবচেয়ে বেশি—১৫০ জন—ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ভর্তি হয়েছেন ৭৮ জন, ঢাকার অন্যান্য অংশে ৪৫ জন, চট্টগ্রামে ৩২ জন, খুলনায় ১৪ জন, রাজশাহীতে ২৯ জন, ময়মনসিংহে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১,৩২৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৫১ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৭৮ জন।
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২ জুলাই এক দিনে ৪১৬ জন রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, যা চলতি বছরে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা। প্রতিদিন আক্রান্তের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জনস্বাস্থ্যখাতে নতুন করে চাপ তৈরি করছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও সরঞ্জাম ও জনবল ঘাটতির কারণে রোগী সেবা ব্যবস্থায় চাপ বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে চীন সরকার বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯ হাজার ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট হস্তান্তর করেছে চীনা দূতাবাস।
এই কিটগুলো এনএস-১, আইজিজি ও আইজিএম একসঙ্গে শনাক্তে সক্ষম, যা রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আরও নির্ভুলতা ও গতি আনবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের ডেপুটি মিশন চিফ লিউ ইউইন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, “ডেঙ্গু এখন শুধু একক সমস্যা নয়, এর সঙ্গে এখন চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণও দেখা দিচ্ছে। অনেক রোগী উপসর্গকে সাধারণ জ্বর ভেবে হাসপাতালে দেরিতে আসছেন, যা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ডেঙ্গুর হটস্পট এলাকাগুলো চিহ্নিত করেছি। এসব এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স, ডায়াগনস্টিক কিটসহ নানা সরঞ্জাম দ্রুত পাঠানো হচ্ছে। চীনের দেওয়া এই কিটগুলোর গুরুত্ব এখানেই—তাৎক্ষণিক শনাক্তে সহায়ক হবে।”
তবে একসঙ্গে বিভিন্ন ভাইরাসের প্রকোপে চিকিৎসকদের পক্ষেও নির্দিষ্ট রোগ শনাক্ত করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ছে। সায়েদুর রহমান বলেন, “আমাদের হাতে পর্যাপ্ত কিট আছে। তারপরও সংকট দেখা দিলে আরও সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছি।”
ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হলেও যথাযথভাবে তা মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “শুধু হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর চাপ দিয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। নাগরিক সচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া ভেক্টর কন্ট্রোল কার্যকর হবে না।”
তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর মুগদা মেডিকেলসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ও চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে রোগীর সংখ্যা যদি আরও বাড়ে, তাহলে সাময়িক চাপ তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
এই সহযোগিতার মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অংশীদারিত্ব নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, “এটি কেবল একটি কিট হস্তান্তর নয়, এটি চীন-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের প্রতীক। ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে বড় আকারের হাসপাতাল প্রকল্প, ইলেক্ট্রো মেডিকেল যন্ত্রপাতি, ভ্যাকসিন সক্ষমতা ও রোবটিক্স প্রযুক্তি নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা চলছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে স্বাস্থ্যখাতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসবে।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার এই সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে। সরকারি হিসাবেই ১১ হাজারের বেশি আক্রান্ত, ৪৫ জনের মৃত্যু এবং তিন দিনে হাজারের বেশি রোগী ভর্তি—পরিস্থিতির গম্ভীরতাকে স্পষ্ট করে। তবে সরকারের দাবি, প্রস্তুতি ও সরঞ্জাম আছে, এখন দরকার জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত সহযোগিতা।
চীনের সহায়তায় শনাক্তকরণে উন্নতি এলেও, রোগ প্রতিরোধে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে উৎস নির্মূল এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে। আর এটাই হতে পারে ভয়াবহতার আগেই সুরক্ষা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ