
ছবি: সংগৃহীত
দেশে চলতি বছরের জুন মাসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা গত মাসের তুলনায় ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জুনের মাত্র ২৮ দিনে ১৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত মারা গেছেন, যেখানে মে মাসে এই সংখ্যা ছিল মাত্র তিনজন। গত ২৪ ঘণ্টায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, মশক নিধন কার্যক্রম দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়েই চলেছে। জুলাইয়ে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, ডেঙ্গু মৃত্যুর সংখ্যা জুন মাসে মে মাসের থেকে ছয় গুণ বেড়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, "এবার ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৪টিতেই গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এডিস মশা এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু অনেক জেলায় এখনও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৪১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর পর্যন্ত দেশে মোট ৯ হাজার ৪৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪১ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১১ জন এবং চট্টগ্রাম বিভাগে চারজন মারা গেছেন। বাকি ১১ জন দেশের অন্যান্য বিভাগের বাসিন্দা।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৩১২ জন, আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৭৫১ জন চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে আসছে। ২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গু রোগে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৫৭৫ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরাজুম মুনিরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকালেই মারা গেছেন। তিনি পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা গ্রামের মনির মিয়ার স্ত্রী। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। গত মঙ্গলবার তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। তার প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালের শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
সিভিল সার্জন মো. আবুল ফাত্তাহ জানান, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ বাড়লেও প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে মশা নিধনে পৌরসভার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে এখনই তৎপর হওয়া প্রয়োজন। এডিস মশার উৎপাত কমাতে বিশেষ মশক নিধন কর্মসূচি কার্যকর করতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে গৃহস্থালির আশেপাশে মশার লার্ভা জন্মদানে বাধা দেওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে যথাযথ ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা আরও প্রসারিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, “জুলাই ও আগস্টে ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বোচ্চ হয়। তাই তৎপরতা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে।” দেশের বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিত কঠোর মনোযোগ দিয়ে মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
ডেঙ্গু শুধু একটি সিজনাল রোগ নয়, এটি দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা ও নিয়মিত মশক নিধন কর্মসূচি সফল না হলে প্রতিটি বছর ডেঙ্গু থেকে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। না হলে আগামী মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এভাবে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপর না হলে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং জনগণের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। যথাযথ পরিকল্পনা, কার্যকর পদক্ষেপ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকারের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম গ্রহণের বিকল্প নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ