
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতির এক সংকটময় সময়ে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে যে 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা পূর্ণ কর্মবিরতি কর্মসূচি শুরু করেছেন, তাতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ সর্বত্রই চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার জেরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে পুরো অর্থনৈতিক প্রবাহ।
ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংগঠিত আন্দোলনের অংশ হিসেবে কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও কর অফিসগুলোতে কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে শুল্ক-কর আদায়, পণ্য খালাস, আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম ও আয়কর রিটার্ন জমাদান সবই বন্ধ। এই একদিনের কর্মসূচিতেই আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার, দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ আন্দোলনকে 'অর্থনীতির শ্বাসনালিকে চেপে ধরা’র সঙ্গে তুলনা করে বলেন, "শুল্ক আদায় না হলে আমদানি-রপ্তানি থেমে যাবে, উৎপাদন ব্যাহত হবে, পণ্য দোকানে পৌঁছাবে না। সরকারের রাজস্ব শূন্যে নেমে যাবে, যা সরকারের কার্যক্রমে বিপর্যয় ডেকে আনবে।"
চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় সেখানে কনটেইনার জট সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এনবিআর কর্মীদের আন্দোলনের প্রভাবে শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের কাস্টমস কার্যক্রম থমকে গেছে। বন্দরে রপ্তানিমুখী পণ্য জাহাজে উঠানো যায়নি, আমদানিকৃত পণ্য খালাস হয়নি।
বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত বন্দরেও পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বেনাপোলে শত শত ট্রাক দুই দেশের সীমান্তে আটকা পড়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামালবাহী। হিলি বন্দরে ভারতের আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে শুল্কায়নের অপেক্ষায়। এভাবে স্থলবন্দরগুলোতেও রাজস্ব কার্যক্রম অচল।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, "এটা এমন সময়ে ঘটছে, যখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছিল। এমন ব্যাঘাতে রপ্তানি, আমদানি ও বিনিয়োগ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, "ব্যবসা-বাণিজ্য এমনিতেই চাপে। এই শাটডাউন পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে।"
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, রবিবারও কমপ্লিট শাটডাউন চলবে। তাঁদের দাবি, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা জানান, এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতিরেকে সব কার্যক্রমে প্রযোজ্য।
রাজস্ব ভবনে শনিবার দিনভর উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করেছে। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড মোতায়েন ছিল। এনবিআর ভবনের সামনে ও ভেতরে অস্ত্রধারী বাহিনীর অবস্থান কর্মীদের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখে। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিতে থাকেন এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগান।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা পরে কমিয়ে করা হয়েছে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু মে পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯৭ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কম। জুন মাসে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আদায় করতে হবে এক লাখ ৩৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। কিন্তু চলমান শাটডাউনের কারণে রাজস্ব আদায় কার্যত শূন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলনের অবসান এখন সময়ের দাবি। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দ্রুত সমঝোতার জন্য তারা প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টাকে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহ সচল রাখতে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধানই একমাত্র পথ বলে মত দিয়েছেন তারা।
বাংলাবার্তা/এসজে