
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নতুন এক সংকটের আবর্তে প্রবেশ করেছে দুই প্রতিবেশী দেশ। বিশেষ করে পাট ও পাটজাত পণ্যের মতো ঐতিহ্যবাহী এবং রপ্তানিনির্ভর খাতের ওপর নতুন এই বিধিনিষেধ বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিধিনিষেধ কার্যকর ছিল; এবার পাট পণ্যেও বাধা আসায় রপ্তানিকারকদের মধ্যে বিপদের ঘণ্টা বাজছে।
গত শুক্রবার (২৭ জুন) ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের ৯ ধরনের পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আর আমদানি করা যাবে না। তবে এ নিষেধাজ্ঞা মুম্বাইয়ের নহ্ভা সেভা বন্দর ব্যবহারে প্রযোজ্য হবে না বলে স্পষ্ট করা হয়। এতে আশার ক্ষীণ আলো দেখা গেলেও বাস্তব পরিস্থিতি আরও জটিল। কারণ, বাংলাদেশের পাট রপ্তানির প্রায় পুরোটা অংশ স্থলবন্দর দিয়েই হতো।
নিষিদ্ধ ঘোষিত পণ্যের তালিকায় রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের সুতা, বোনা কাপড়, একক সুতা, রোল ফর্ম পণ্য এবং কিছু বিশেষ ধরনের কাপড়। এসব পণ্য থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল প্রায় ১৫ কোটি মার্কিন ডলার, যার মধ্যে প্রায় সবই স্থলবন্দর হয়ে ভারতে গেছে। রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, এর মধ্যে মাত্র ২০ লাখ ডলারের পণ্য নৌ বা আকাশপথে গেছে, বাকিটা স্থলপথে।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও রাজবাড়ী জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ শামসুল আবেদিন জানান, তারা এখন বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। যদিও ভারতের নিষেধাজ্ঞা কাঁচা পাট রপ্তানির পথ বন্ধ করে দিচ্ছে, তবে বিকল্প হিসেবে নৌপথে রপ্তানির সুযোগ কাজে লাগাতে আলোচনা শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফল?
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপোড়েনকেই অনেক বিশ্লেষক এসব নিষেধাজ্ঞার পেছনের কারণ হিসেবে দেখছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এই ধরনের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক অস্থিরতারই প্রতিফলন। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের বাণিজ্যে অনেক বেশি পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতের বাজারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত ছিল তৈরি পোশাক, তারপরে পাট। এখন দুটি খাতেই সংকট দেখা দিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমেই এই সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে।” ড. রহমান মনে করেন, উভয় দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অচিরেই প্রত্যাহার করা উচিত।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীরবতা
এত বড় পরিবর্তন ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মাঝেও এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ভারত সরকারের ঘোষণার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এই নীরবতা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে।
বহু ধাপে বিধিনিষেধ
শুধু এই নিষেধাজ্ঞাই নয়, গত কয়েক মাস ধরেই ভারত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর একাধিক ধাপে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। এরপর ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, ফল-ফলাদির রস, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানিতে বিধিনিষেধ জারি করা হয়।
অপরদিকে ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। তবে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি তুলনামূলকভাবে কম হলেও ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী। ভারত থেকে বছরে বাংলাদেশ ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে, যেখানে রপ্তানি মাত্র ১৫৭ কোটি ডলার (২০২৩-২৪ অর্থবছরে)। ফলে অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষেরই ক্ষতি করলেও বাংলাদেশের বিপদ বেশি।
ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি
তৈরি পোশাকের পর পাটই ছিল বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিযোগ্য পণ্য ভারতে। যদিও ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক আরোপ করে, যা ২০২৩ সালে আরও পাঁচ বছর মেয়াদে বাড়ানো হয়। তবুও বাংলাদেশ ভারতের বাজারে পাট রপ্তানিতে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছিল। এখন নতুন নিষেধাজ্ঞা সেই ধারা ব্যাহত করবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
শেখ শামসুল আবেদিন বলেন, “পাটের ফিনিশড গুডস উৎপাদন এখন বাড়ানোর সময়। কারণ, কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পের জন্য কাঁচামাল বাড়বে। তবে সমস্যা হলো, এত কম সময়ে বাজার পরিবর্তন বা নতুন গন্তব্য পাওয়া কঠিন।”
পরিসংখ্যান বলছে বিপদের কথা
পাট অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছরের মার্চ মাসেই বাংলাদেশ ১২টি দেশে ৬৯৮ কোটি টাকার কাঁচা পাট রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে ভারতেই গেছে ৪৪৮ কোটি টাকার বেশি। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু ভারতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৯ কোটি টাকার কাঁচা পাট, যা পুরোটাই স্থলবন্দর দিয়ে গেছে।
এমনকি তৃতীয় দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও ভারত হয়ে যাওয়ায় বাংলাবান্দা স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ বেল পাট ভারতে গেছে। এখন এসব রপ্তানি বাধার মুখে পড়ায় শুধু রাজস্ব নয়, কৃষক ও পাটশিল্পের অস্তিত্বও ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান বলেন, “ভারত বাংলাদেশের পণ্য স্থলপথে আমদানি প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে চললে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আর নৌপথে যেভাবে রপ্তানি অব্যাহত রাখার কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে সেটা এত সহজ নয়।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশকে এখন দ্রুত কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে সক্রিয় হতে হবে। এই অচলাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা শুধু অর্থনীতির ক্ষতিই বাড়াবে না, দুই দেশের সম্পর্কেও গভীর আঘাত হানবে।”
ভারতের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোতে এর সরাসরি প্রভাব ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক বার্তা বহন করছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ ও দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসভিত্তিক আলোচনার আয়োজন। কারণ, প্রতিবেশী দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অবহেলার নয়—এ সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ