
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এমন একটি সময়ে, যখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নির্বাচনি মাঠে অনুপস্থিত, তখনও আসন্ন নির্বাচনকে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করছে বিএনপি। তারা মনে করছে, এই নির্বাচন হচ্ছে তাদের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট, যার মধ্য দিয়ে তারা দেশকে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে চায়। আর এই লক্ষ্যে এখন থেকেই দলীয়ভাবে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের জন্য একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ তৈরি করছেন তিনি। দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের জন্য সাজানো হচ্ছে বিস্তারিত নির্বাচনি কর্মসূচি। উদ্দেশ্য, নির্বাচনকে ঘিরে সংগঠনের শক্তি ও জনগণের সমর্থনকে একত্র করে একটি বিজয়ী রূপ দেওয়া। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে যোগ্য প্রার্থী বাছাই। আর এই বাছাই হবে কঠিন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে। চারিত্রিক সততা, দলের প্রতি আনুগত্য, আন্দোলনকালীন ভূমিকা, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং পারিবারিক পটভূমির মতো একাধিক বিষয়ে যাচাই-বাছাই করেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার সংসদ সদস্য প্রার্থী হতে হলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একটি কঠিন বৈতরণী পার হতে হবে। শুধু জনপ্রিয়তা নয়, বরং একাধিক নৈতিক ও প্রশাসনিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে তাঁদের। তারেক রহমান প্রার্থীদের গত এক দশকে দলের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অবদান, রাজনৈতিক ত্যাগ ও মামলা-কারাবরণের ইতিহাস যাচাই করে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করবেন।
এ ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উপার্জনের উৎস, আয়-ব্যয় এবং সম্পদের হিসাবপত্র দলের হাইকমান্ডের কাছে জমা দিতে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে কেবল জনসমর্থন নয়, আর্থিক স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে তিন মাসের একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে বিএনপি। এই কর্মসূচিতে থাকবে:
প্রার্থীদের আচরণবিধি: সাধারণ ভোটার, অন্যান্য দলের নেতা-কর্মী এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতি কেমন আচরণ করবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এলাকা ভিত্তিক জনসচেতনতা তৈরির বিষয়েও দিকনির্দেশনা থাকবে।
তৃণমূল নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণ: ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন, জাল ভোট প্রতিরোধ, সহিংসতা রোধ এবং ফলাফল গ্রহণে প্রহরা দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ পাবে পোলিং এজেন্ট, কেন্দ্র কমিটি ও সহায়ক টিমগুলো।
পোলিং এজেন্ট প্রস্তুতি: একটি কেন্দ্রের জন্য তিনজন করে পোলিং এজেন্টের তালিকা প্রস্তুত রাখা হবে। যাতে এক এজেন্ট অনুপস্থিত হলে দ্রুত বিকল্প নিয়োগ দেওয়া যায়। এবারের নির্বাচনে পোলিং এজেন্টদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রাখা হবে।
প্রচার কৌশল: ৩১ দফা দাবির বাইরে আরও কিছু এলাকা-ভিত্তিক ইস্যু নির্ধারণ করে ভোটারদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে প্রচার কৌশল সাজানো হবে। কোন এলাকায় কোন ইস্যুতে প্রচার চালাতে হবে, তা কেন্দ্রীয়ভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ভোট গণনা ও ফলাফল প্রহরা: ভোট গ্রহণের পর গণনা এবং ফলাফল ঘোষণার সময় কে কোথায় অবস্থান করবেন, কী দায়িত্ব পালন করবেন তা পূর্বনির্ধারিত থাকবে। এই কাজে আইনি সীমা ও নিয়ম মেনেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
অন্য দলের সঙ্গে সম্পর্ক ও আচরণ: নির্বাচনি মাঠে অন্য দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, তাও আচরণবিধিতে স্পষ্ট করা হবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ডিজিটাল অপপ্রচারের বিরুদ্ধে টিম: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তথ্য-ভিত্তিক প্রতিউত্তর দিতে দক্ষ ডিজিটাল টিম গঠন করা হবে। যারা বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলা করবে, দলের ভাবমূর্তি রক্ষা করবে।
যেসব শরিক দল ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে, তাদের জন্যও এই আচরণবিধি, প্রার্থী যাচাই এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। এতে দলের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় থাকবে বলে মনে করছেন নেতারা।
বিএনপির এই কর্মপরিকল্পনা নির্বাচনকে ঘিরে দলটির দৃষ্টিভঙ্গির এক সাহসী উদাহরণ। তারা প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতির সুযোগে নয়, বরং নিজেদের শৃঙ্খলা, প্রস্তুতি ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো—এই পরিকল্পনা বাস্তবে কতটা সফল হবে এবং কতটা প্রভাব ফেলবে ভোটারদের মনে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ