
ছবি: সংগৃহীত
চলমান এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সংকট দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। তাঁরা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিকে ‘অগ্রহণযোগ্য ও অকার্যকর’ আখ্যায়িত করে দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, আজ একজনের অপসারণ চাওয়া হলে কাল সেটা অন্যদের ক্ষেত্রেও হতে পারে—এভাবে সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। তাঁরা বলছেন, সংকট নিরসনে আলোচনার জন্য ১ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা নয়, বরং আজ, এখনই আলোচনা শুরু করা উচিত।
শনিবার (২৯ জুন) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেশের ১৩টি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এই অবস্থান তুলে ধরেন। এতে উপস্থিত ছিলেন চেম্বার, শিল্পমালিক, রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট নেতারা।
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন—আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান, বিসিএমইএ সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খানসহ আরও অনেকে।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, “চলমান আন্দোলনের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, ঢাকার বিমানবন্দরসহ দেশের প্রধান প্রধান কাস্টম হাউজগুলোতে পণ্য আটকে থাকছে। এর ফলে রপ্তানিকারকরা সময়মতো কাঁচামাল পাচ্ছেন না, উৎপাদন ও ডেলিভারি ব্যাহত হচ্ছে।”
তাঁরা উল্লেখ করেন, “একটি প্রভাবশালী সংস্থার সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তিকে অপসারণের দাবি একটি পূর্বাপর হুমকি তৈরি করতে পারে। আজ যদি এনবিআর চেয়ারম্যানকে সরাতে হয়, কাল অন্য সংস্থার প্রধানকে নিয়েও একই দাবি উঠবে। এটি একটি ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ তৈরি করবে, যা সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, “সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া খুব জরুরি। তবে দুঃখজনকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেই সংলাপ এখন স্থিমিত। চেয়ারম্যানের অপসারণ দিয়ে যদি সমাধান হতো, তবে সেটি ভেবে দেখা যেত। কিন্তু তাতে বরং আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।”
এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রেও কাস্টমস অফিস বন্ধ থাকে না। অথচ আমরা সেটিই এখন দেখছি। আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে না। এভাবে আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়া মানে পুরো অর্থনীতিকে চরম ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া।”
বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “এনবিআরে সমস্যা ক্ষমতা ও অর্থ বণ্টন নিয়ে। এতদিন তারা ব্যবসায়ীদের জ্বালিয়েছে, এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে। এই ঝগড়া জাতির ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। তাই আলোচনার মাধ্যমেই এর সুরাহা জরুরি।”
বক্তারা বলেন, কলম বিরতির কারণে এখন ১০ থেকে ১৫ দিনেও ইউপি (ইউনিট প্রোফাইল) পাওয়া যাচ্ছে না। বন্দরে পণ্য পড়ে থাকছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফলমূল ও অন্যান্য নষ্টযোগ্য পণ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিনির্ভর খাতগুলো।
তাঁরা বলেন, “সব কর্মকর্তা দুর্নীতিপরায়ণ নয়। অনেকে সৎ ও পেশাদার। বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। সেই বিবেচনাতেও সরকারকে গঠনমূলক ও সমঝোতার ভিত্তিতে এগোতে হবে।”
সাত দফা সুপারিশ
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সাত দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়:
আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অবিলম্বে স্বাভাবিক সেবা নিশ্চিত করা।
রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করার বিতর্কিত অধ্যাদেশ নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা।
স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত থেকে আন্তর্জাতিক মান ও দেশের বাস্তবতার আলোকে কার্যক্রম বাস্তবায়ন।
হয়রানিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা বাড়ানো।
বিনিয়োগ ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে সমন্বিত সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ।
অর্থ, বাণিজ্য, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কার্যকর সমন্বয়।
কোনো শর্ত ছাড়াই আন্দোলন প্রত্যাহারের মাধ্যমে কর্মসূচি থেকে সরে এসে কাজ শুরুর আহ্বান।
ব্যবসায়ী নেতারা এই সংকটকে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য এক ‘সিস্টেমিক রিস্ক’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, আলোচনাই একমাত্র পথ। অপসারণ নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে সমাধান হলেই কেবল রপ্তানি, আমদানি, বন্দর কার্যক্রম এবং সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য আবার স্বাভাবিক হতে পারে।
তাঁদের আহ্বান—আজই আলোচনা শুরু হোক। দেরি নয়, প্রতিটি মুহূর্ত এখন অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এসজে