
ছবি: সংগৃহীত
রাজস্ব খাতে সংস্কার এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণের দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হওয়া কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি এখন দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটিয়েছে।
শনিবার (২৮ জুন) সকাল ছয়টা থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দিন শুরু হতেই। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় বন্দরে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে আছে রাস্তায়। জেটির ভেতরেও সৃষ্টি হয়েছে কনটেইনারবোঝাই ট্রাকের দীর্ঘ জট। অনেক ট্রাক ডিপোর ভেতর অপেক্ষায়, কারণ কাস্টমস অনুমোদন ছাড়া এক ইঞ্চিও এগোনোর সুযোগ নেই।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির আওতায় সকাল থেকেই বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানির পণ্যের শুল্কায়ন। এর ফলে আমদানি করা পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না, আবার রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দরে আসা পণ্যও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় ঢুকতে পারছে না। পূর্বনির্ধারিত অনুমোদন থাকা কনটেইনারগুলো নামানো ও তোলার কাজ চললেও, নতুন কোনো জাহাজ যদি আজ বন্দরে আসে এবং তার শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে তা জেটিতে ভিড়লেও কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের শাটডাউন কর্মসূচি শুধু চট্টগ্রাম নয়, বরং পুরো দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত হানছে।
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা চরম বিপাকে পড়েছি। পণ্য খালাস থেকে শুরু করে শুল্কায়ন, প্রত্যেক ধাপে কাস্টমসের অনুমোদন জরুরি। কাস্টমস না থাকলে কার্যক্রম চলে না। ফলে আজ সকাল থেকে কার্যত সব আটকে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অচলাবস্থা একদিন থাকলেও বন্দরে জাহাজজট, ডেমারেজ ফি, ব্যবসায়ীদের ক্ষতি এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার মতো নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এখন যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তাহলে এই সংকট ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পার্সোনাল অফিসার নাসির উদ্দিন বলেন, “আমরা এখনও জেটিতে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। তবে যেসব জায়গায় কাস্টমসের অনুমোদন জরুরি, সেখানে কিছু সমস্যা হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়া যেন থমকে না যায়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি।”
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, “আগের অনুমোদন থাকায় কিছু কনটেইনারের কাজ চলছে। কিন্তু যেসব জাহাজ নতুন করে এসেছে বা আসবে, তাদের জন্য শুল্কায়ন না হওয়ায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এতে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। সরকারকে দ্রুত এ পরিস্থিতি সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।”
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ ২১ জুন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ২৩ জুন থেকে কলম বিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছিল। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার চেষ্টা হলেও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণসহ একাধিক দাবিতে আন্দোলনরতরা 'কমপ্লিট শাটডাউন' চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এরই অংশ হিসেবে ২৮ জুন থেকে সারা দেশের শুল্ক ও কর দপ্তরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জড়িত হাজারো ব্যবসায়ী ও শ্রমিক এখন আতঙ্কে দিন পার করছেন। যেসব ব্যবসায়ীরা এলসি (ঋণপত্র) খোলার নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য খালাস করতে ব্যর্থ হবেন, তারা ব্যাংক চার্জের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় নানান জটিলতার মুখে পড়তে পারেন।
এছাড়া, যদি এই পরিস্থিতি আরও কয়েকদিন স্থায়ী হয়, তাহলে দেশের বাজারে অনেক পণ্যের সরবরাহ কমে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনাও দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর খাদ্যপণ্য, ঔষধ, শিল্পের কাঁচামালসহ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের খালাসে দীর্ঘসূত্রতা মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
সব পক্ষই এখন একটি সমাধানের দিকে তাকিয়ে আছে। সিঅ্যান্ডএফ, শিপিং, আমদানি-রপ্তানিকারক এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ—সবাই চাইছেন, সরকার দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাক এবং দেশের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র আবার সচল হোক।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি ঘণ্টা দেরি মানে দেশের রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি। তাছাড়া, এই সংকট দীর্ঘ হলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা অংশীদারদের আস্থা হারাতে পারে বাংলাদেশ, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কেবল একটি জাহাজ উঠানামার জায়গা নয়, এটি দেশের অর্থনীতির হৃৎস্পন্দন। সেখানে পণ্য খালাস ও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়া মানে পুরো দেশের শিল্প ও বাণিজ্য কার্যক্রমে বড় ধরনের ধাক্কা। এনবিআর সংস্কার নিয়ে দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে সব পক্ষকেই দ্রুত আলোচনায় বসে বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
বাংলাবার্তা/এসজে