
ছবি: সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বো টেস্টে শেষ দিন সকালটা বাংলাদেশের জন্য যে ভয়াবহ হতে চলেছে, তা হয়তো আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। তবে মাত্র ৩০ মিনিটে, মাত্র ৩৪ বলের মধ্যে পুরো ইনিংস গুটিয়ে যাবে—এটা কল্পনাও করেনি কেউ। আর তাতেই শেষ হলো বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর, ইনিংস ও ৭৮ রানের ব্যবধানে হার মানতে হলো নাজমুল হোসেন শান্তর দলকে।
শনিবার (২৮ জুন) সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের চতুর্থ দিনে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হলো টাইগাররা। প্রবাত জয়সুরিয়ার বাঁহাতি স্পিন ঘূর্ণির সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করল বাংলাদেশের ব্যাটাররা। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ থামে ১৩৩ রানে, আর তার জবাবে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা করেছিল ৪৫৮ রান। আগের দিন ৬ উইকেটে ১১৫ রানে দিন শেষ করেছিল বাংলাদেশ, হাতে ছিল ৪ উইকেট। সেখান থেকে আর মাত্র ১৮ রান যোগ করেই অলআউট হয়ে যায় সফরকারীরা।
যাকে ঘিরে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের ক্ষীণ আশা ছিল, সেই লিটন দাসই চতুর্থ দিনের প্রথম আঘাতে ফিরে যান। দিনের মাত্র পঞ্চম বলেই প্রবাত জয়সুরিয়ার ঘূর্ণিতে কট বিহাইন্ড হন লিটন। ৪৩ বল মোকাবিলা করে ১৪ রান করেই ফিরে যান তিনি। এরপর একে একে উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ।
নাঈম হাসান ব্যাটে-বলে স্পষ্ট দুর্বলতা নিয়ে ক্রিজ ছেড়ে যান মাত্র ৫ রান করে। প্রবাতের টানা তিন ওভারে তিনি তুলে নেন ৩ উইকেট। তার পঞ্চম উইকেট ছিল তাইজুল ইসলাম, যিনি ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন। শেষ ব্যাটার হিসেবে ৬ রান করা ইবাদত হোসেন এলবিডব্লিউ হন থারিন্দু রত্নায়েকের বলে।
বাংলাদেশের ইনিংসের একমাত্র আশা হয়ে ছিলেন নাহিদ রানা, যিনি অপরাজিত থাকেন। কিন্তু সঙ্গী না পেয়ে তিনিও দাঁড়াতে পারেননি দলকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলতে।
এই সিরিজে প্রথম তিন ইনিংসে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেননি প্রবাত জয়সুরিয়া। তবে কলম্বো টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে যেন বদলে গেলেন তিনি। ৫৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দলকে এনে দিলেন ইনিংস ব্যবধানে বড় জয়। বাংলাদেশের পুরো ব্যাটিং লাইনআপ তার টার্ন আর ফ্লাইটের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করল।
এই নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ ৪৭তম বার ইনিংস ব্যবধানে হারের মুখ দেখল। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এটি নবম ইনিংস ব্যবধানের হার। শুধু এই সংখ্যাগুলিই বলে দেয়, বাংলাদেশ এখনও কতটা পিছিয়ে টেস্ট মানসিকতায়।
এই ম্যাচের ম্যাচসেরা নির্বাচিত হয়েছেন শ্রীলঙ্কার ওপেনার পাতুম নিসাঙ্কা। প্রথম ইনিংসে ১৫৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন তিনি, যার ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠে শ্রীলঙ্কার বিশাল স্কোর। আগের টেস্টেও ১৮৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন এই ডানহাতি ওপেনার। দুই ম্যাচে ধারাবাহিক এমন পারফরম্যান্সের সুবাদে সিরিজসেরার পুরস্কারও উঠেছে তার হাতেই।
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ৪৫৮ রান করলেও বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস থেমেছিল ২৪৭ রানে। সেই ঘাটতি মেটানোর দায়টা ব্যাটাররা নিতে পারেননি দ্বিতীয় ইনিংসে।
এই ইনিংস ব্যবধানে হারের পর সিরিজও ১-০ ব্যবধানে হাতছাড়া হয়েছে বাংলাদেশের। গলে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টটি ছিল ড্র, তবে কলম্বোর এই টেস্ট জিতে সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছে ধনঞ্জয়া ডি সিলভার দল। ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর টেস্ট দলের নেতৃত্বে থাকছেন না।
শান্ত বলেন, "দলের স্বার্থে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের আরও দায়িত্বশীল ও পরিণত ক্রিকেট খেলতে হবে।"
বাংলাদেশের এই পরাজয়ে আরও একবার ফুটে উঠল টেস্ট ক্রিকেটে দেশের দুর্বল মানসিকতা, ব্যাটিংয়ের ভঙ্গুরতা এবং টেকসই পরিকল্পনার অভাব। টেস্টের চতুর্থ দিনে মাত্র ৩৪ বলেই ৪ উইকেট হারিয়ে হেরে যাওয়া বিশ্ব ক্রিকেটে বড় লজ্জার বিষয়। কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের এখন সময় এসেছে গভীরভাবে ভাবার—বাংলাদেশের টেস্ট ভবিষ্যৎ কীভাবে গড়া হবে।
এই সফর শেষে বাংলাদেশের টেস্ট র্যাংকিং ও বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্টেও বড় ধাক্কা এসেছে। বিপরীতে, শ্রীলঙ্কা জয়ের ধারায় থেকে টেস্ট খেলুড়ে বড় দলগুলোর তালিকায় আরও একটি সংহত জয় সংযুক্ত করল।
বাংলাদেশের কলম্বো টেস্ট ছিল না কোনো প্রতিরোধ, না কোনো লড়াইয়ের গল্প। ছিল কেবল আত্মসমর্পণের বিবরণ। শ্রীলঙ্কার শক্তিমত্তার কাছে ব্যর্থতা ঢাকতে পারেনি কোনো অজুহাত। প্রবাত জয়সুরিয়ার ঘূর্ণিতে ছিন্নভিন্ন ব্যাটিং লাইনআপ এবং নিসাঙ্কার ধারাবাহিক সেঞ্চুরির দাপটে ইনিংস ও ৭৮ রানের বড় পরাজয়—এই টেস্ট থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
এখন সামনে প্রশ্ন একটাই—এই হার থেকে দল কী শিক্ষা নেবে, এবং আদৌ কী সামনের সিরিজে সেই শিক্ষা কাজে লাগাতে পারবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ