
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর চেয়ারম্যানের অপসারণ এবং অংশগ্রহণমূলক রাজস্ব সংস্কারের দাবিতে উদ্ভূত চলমান অচলাবস্থা আরও জটিল রূপ নিতে যাচ্ছে। আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘোষণা দিয়েছেন, শনিবারের মতো রোববার (২৯ জুন) দিনব্যাপী “কমপ্লিট শাটডাউন” ও রাজধানীমুখী “মার্চ টু এনবিআর” কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এনবিআরের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, যা শুধু একটি প্রশাসনিক সংকট নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ এবং আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেও একপ্রকার সরব প্রতিবাদ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
শনিবার দুপুরে আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন সংগঠন ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত রাজস্ব কর্মকর্তারা সকাল থেকেই এনবিআর প্রধান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করেন। ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে, শান্তিপূর্ণভাবে তারা অবস্থান নেন ভবনের প্রবেশমুখে। মুখে একটাই দাবি—“অবিলম্বে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের অপসারণ” এবং অংশগ্রহণমূলক, টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক রাজস্ব সংস্কার।
ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এক আবেগপ্রবণ বক্তৃতায় বলেন, “আমরা পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, ব্যবসায়ীরা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ তাদের কাম্য নয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও বাস্তবতা বিবর্জিত। কেন একজন আমলাকে রক্ষা করতে গিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ এমন অবস্থান নিল তা তারা ব্যাখ্যা করেনি। আমরা স্পষ্ট করছি—এই চেয়ারম্যান সরকারের পতনের সহযোগী এক আমলা, যিনি রাজস্ব খাতকে আমলাতান্ত্রিক দখলদারিতে পরিণত করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ব্যবসায়ী সমাজকে অসম্মান করছি না, তবে তাদের এই অবস্থান আমলাতান্ত্রিক শাসনের দোসরদেরই প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমরা আমাদের বিবৃতি এবং কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণ ও ব্যবসায়ী সমাজকে জানিয়ে দিতে চাই—এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তি বিদ্বেষ নয়, এটি একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের ডাক।”
শুক্রবার শুরু হওয়া ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি এখন দেশজুড়ে রাজস্ব দপ্তরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগ মিলিয়ে হাজার হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী এখন এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। হাছান তারেক রিকাবদার জানান, “২৯ জুন রোববারও লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন চলবে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এই শাটডাউনের আওতামুক্ত থাকবে।”
একই দিনে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে ‘শান্তিপূর্ণ মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি। এতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার আন্দোলনরত কর্মীরা অংশ নেবেন। আগের দিনগুলোর মতোই এনবিআর কার্যালয়ের প্রবেশপথ ঘিরে বিক্ষোভ, স্লোগান ও মানববন্ধনের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, আন্দোলনকারীদের প্রতি আলোচনার ডাক দেওয়া হলেও এতে সন্তুষ্ট নন নেতারা। সংগঠনের মহাসচিব সেহেলা সিদ্দিকা বলেন, “আমরা আলোচনা করতে প্রস্তুত। কিন্তু কেন এত দেরি করে আগামী মঙ্গলবার ডাকা হলো? আলোচনার সদিচ্ছা থাকলে আজকেই ডাক দেওয়া যেত। আমাদের আন্দোলন যদি গুরুত্ব পায়, তবে আলোচনার জন্য অপেক্ষা কেন?”
তিনি বলেন, “আমরা আলোচনায় যাব, তবে সেটা হবে যৌক্তিক রাজস্ব সংস্কারের দাবিতে। এনবিআর চেয়ারম্যান এই দাবির প্রথম প্রতিবন্ধকতা। তিনি না থাকলে কাঠামোগত সংস্কার সম্ভব হবে।”
আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এনবিআর ভবন বর্তমানে কার্যত ঘেরাও অবস্থায় রয়েছে। আন্দোলনের অন্যতম নেতা অতিরিক্ত কর কমিশনার ও সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা জানান, “গত তিন দিন ধরে এখানে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভবনের চারপাশে জলকামান ও বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। একজন আমলাকে সকাল ৬টায় সশস্ত্র নিরাপত্তা দিয়ে অফিসে আনা হচ্ছে—এটা স্বাভাবিক নয়।”
তিনি অভিযোগ করেন, “আমরা যে ভবনের সামনে অবস্থান করছি, সেখানে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। এ যেন একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থা। কর্মচারীরা বাইরে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থান করছে, অথচ ভেতরে একজন সচিব সুরক্ষিত অবস্থায় অফিস করছেন—এ কেমন প্রশাসনিক অবস্থা?”
এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজধানীর একটি হোটেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন ব্যবসায়ীরা। তারা সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। তবে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটি নিয়েই আন্দোলনকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
হাছান তারেক বলেন, “আমরা ব্যবসায়ী সমাজের অবস্থানকে সম্মান করি, তবে তারা এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের বিরোধিতা করে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। আমরা বারবার বলেছি, এনবিআর চেয়ারম্যান হচ্ছে এই সংস্কারের প্রধান প্রতিবন্ধক। তাকে রেখে কোনো আলাপ-আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না।”
সব মিলিয়ে, এনবিআরকে ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা এখন শুধু একটি দপ্তরের কর্মসূচি নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বনাম মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শক্তি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবিবার (২৯ জুন) দ্বিতীয় দিনের মতো কমপ্লিট শাটডাউন ও এনবিআর অভিমুখে ‘মার্চ’ কর্মসূচি এই উত্তেজনার মাত্রা আরও বাড়াবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। সরকার আলোচনায় বসে কোনো সমাধানে পৌঁছায় কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এসজে