
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় এবার যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান-ইসরাইল সংঘাত নিরসনের পর এবার গাজা যুদ্ধ থামাতেও আশার আলো দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর মতে, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার চলমান যুদ্ধ বন্ধ করে এক সপ্তাহের মধ্যেই কার্যকর যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
গতকাল শুক্রবার (২৭ জুন) হোয়াইট হাউসে আফ্রিকার কঙ্গো ও রুয়ান্ডার মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, গাজা যুদ্ধ অবসানের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং ‘যুদ্ধবিরতি এখন খুব কাছাকাছি’। তার ভাষায়, "আমি সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছি যারা এই শান্তিপ্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। মনে হচ্ছে, খুব শিগগিরই আমরা একটি ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পারব।"
এই সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইতোমধ্যে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা বলেছে, যুদ্ধ থামানোর যে কোনো চুক্তির আওতায় গাজায় ইসরাইলি অভিযানে জিম্মি হয়ে থাকা অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রস্তুত রয়েছে তারা। এটি যুদ্ধবিরতির একটি প্রধান পূর্বশর্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হামাসের এক মুখপাত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলেন, “আমরা যুদ্ধ থামাতে চাই, কিন্তু তা হতে হবে সম্মানজনক এবং ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার স্বার্থ সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে। জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, তবে অস্ত্র সমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না।”
অন্যদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র সরকার এখনও অনড় অবস্থানে। তারা বলেছে, হামাস পুরোপুরি বিলুপ্ত এবং নিরস্ত্র না হওয়া পর্যন্ত গাজা যুদ্ধ চলতেই থাকবে। এক বিবৃতিতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) জানিয়েছে, "যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হলো হামাসকে সামরিকভাবে ধ্বংস করা এবং গাজা উপত্যকা থেকে সন্ত্রাসী উপস্থিতি পুরোপুরি নির্মূল করা।"
ইসরাইলি বাহিনীর হামলা ও বিমান অভিযানে গাজার পরিস্থিতি চরম মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৫৬,৩৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৩২ জন।
এই সহিংসতার সূচনা হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, যেদিন হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলের সীমান্ত পেরিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নিহত এবং ২৫১ জন জিম্মি হন। সেই ঘটনার পর প্রতিশোধ ও জিম্মি উদ্ধারের অজুহাতে ইসরাইল টানা ১৫ মাস ধরে গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, যা আংশিক স্বস্তি এনে দিয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনিদের। কিন্তু শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইল ফের বড় পরিসরে হামলা শুরু করে, যার ফলে দ্বিতীয় দফার অভিযানে গত আড়াই মাসে আরও ৬ হাজার ৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং আহত হন ২০ হাজার ৫৯১ জন।
গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ট্রাম্পের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকে মনে করছেন, আমেরিকার নির্বাচনী রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া ট্রাম্প এই বার্তা দিয়ে আবারও নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এর আগে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি এবং ইরান-ইসরাইলের টানাপোড়েন কমাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর ভূমিকার দাবি নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনা হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে কেবল কূটনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে যুদ্ধ থামানো কঠিন হবে। বিশেষ করে যখন ইসরাইল হামাসকে অস্ত্রহীন ও বিলুপ্ত করার বিষয়ে অনড় এবং হামাস স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বহু বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর মধ্যপ্রাচ্য কৌশল অনেকটাই অপ্রচলিত ছিল। এবারও তাঁর কৌশল গতানুগতিক কূটনীতির বাইরে যেতে পারে। তবে তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যে যেভাবে আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে, তাতে কিছু পর্যবেক্ষক আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ড. লিয়া গারফিনকেল বলেন, “যদি ট্রাম্প সত্যিই হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে এমন কোনো শর্ত তৈরি করতে পারেন, যা উভয়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে এটি হবে এক যুগান্তকারী কূটনৈতিক সাফল্য। কিন্তু কাজটি সহজ নয়।”
গাজায় রক্তাক্ত সংঘাতের অবসান চায় গোটা বিশ্ব। শিশুদের করুণ মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া আবাসন, এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাজুড়ে লাগাতার বোমা বর্ষণের মধ্যে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে সেই আলো কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, তা নির্ভর করবে ইসরাইল ও হামাসের পরবর্তী অবস্থানের ওপর—এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বাস্তবায়নক্ষম মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার ওপর। এখন সবার নজর সেই ঘোষিত "এক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধবিরতি" বাস্তবায়নের দিকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ