
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান শুল্কবিষয়ক দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক ঘোষিত ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশ একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে। সেই লক্ষ্যেই উভয় দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক দফা উচ্চপর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (USTR)-এর সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। আলোচনার পরে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দুই পক্ষই “চুক্তিটি দ্রুত চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আন্তরিক” এবং এ বিষয়ে “গঠনমূলক অগ্রগতি” হয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানি বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে বেশ কয়েকটি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। এর আওতায় বাংলাদেশের পোশাকসহ বেশ কয়েকটি প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।
তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধাক্কা সামাল দিতে ট্রাম্প প্রশাসন ৯ এপ্রিল ওই বাড়তি শুল্ক তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করে। এই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৮ জুলাই। ফলে তার আগেই চূড়ান্ত চুক্তি সই করে অতিরিক্ত শুল্ক স্থায়ীভাবে এড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে একটি প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে বাংলাদেশে, যাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় যৌথ উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। ঢাকা থেকে ওই খসড়ায় কিছু সংশোধন ও মতামত সংযুক্ত করে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছে। এর ভিত্তিতেই গত বৃহস্পতিবারের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে জানা যায়, দুই পক্ষই কিছু বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে এবং বাকি বিষয়গুলো নিয়েও ইতিবাচক আলোচনা চলছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিটিএডি)-এর সাবেক বাণিজ্য নীতি প্রধান ও বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. খলিলুর রহমান বলেন, “মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। উভয় পক্ষই একটি গ্রহণযোগ্য ও টেকসই চুক্তির পথে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় মিলবে বলে আশা করছি, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।”
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন রোববার (২৯ জুন) আবারও ওয়াশিংটনে দু’দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আরেক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে বাকি বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত চুক্তি প্রস্তুতের চেষ্টা করা হবে। বাংলাদেশ আশা করছে, ওই বৈঠকেই চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হবে এবং ৮ জুলাইয়ের আগেই চুক্তিতে স্বাক্ষর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তি শুধুই শুল্ক ছাড় পাওয়ার বিষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির একটি বড় অর্জন হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। এতে দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি প্রবেশাধিকার সহজ হবে এবং সম্ভাব্য বাণিজ্য সংকট এড়ানো যাবে।
চুক্তির আওতায় কী কী শর্ত থাকছে, তা বিস্তারিত জানা না গেলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে ন্যূনতম ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক যেসব দেশের ওপর কার্যকর রয়েছে, বাংলাদেশ চাইছে সেই তালিকা থেকেও নিজেদের বাদ রাখতে। এছাড়া কিছু কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
একজন সিনিয়র বাণিজ্য কর্মকর্তা জানান, “আমাদের রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রমুখী। এই শুল্ক জারি থাকলে তা ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। তাই এই চুক্তি বাংলাদেশ সরকারের জন্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), রপ্তানিমুখী হিমায়িত খাদ্য শিল্প সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন এই আলোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “এই আলোচনায় অগ্রগতি আমাদের আশাবাদী করছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক ছাড় পেলে আমাদের রপ্তানি খাত নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই শুল্ক আলোচনা শুধু একক বাণিজ্য চুক্তি নয়, বরং এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু রপ্তানি বাজার টিকিয়ে রাখবে না, বরং সেখানে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারবে।
৮ জুলাইয়ের আগে চূড়ান্ত চুক্তি না হলে আবারও শুল্ক জারি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। ফলে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ও আলোচনার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে দেশের বৃহৎ শিল্প ও রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ। এখন সকলের নজর রোববারের বৈঠকের দিকে, যেখানে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ