
ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক ব্যবসার ধারণা কেবল দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার নয়, বরং এটি সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও মানবিক কাঠামো পাল্টে দেওয়ার শক্তিশালী একটি মডেল—এমন মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার (২৭ জুন) সকালে সাভারের জিরাবোতে অবস্থিত সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে ২০২৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
বিশ্বের ৩৮টি দেশ থেকে আগত ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে শুরু হওয়া এই সম্মেলনকে সামাজিক ব্যবসার একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উল্লেখ করেন ইউনূস। তিনি বলেন, “আজ আমরা এমন একটি বিশ্বে বসবাস করছি, যেখানে বাণিজ্যের মুনাফাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক উন্নয়নের বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সামাজিক ব্যবসা এমন একটি ধারণা, যার মাধ্যমে লাভ নয়, বরং মানুষের কল্যাণই হয় মূল লক্ষ্য। এই মডেলকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও চিকিৎসা-সংকটের মতো বৈশ্বিক সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব।”
‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা’—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত এবারের সম্মেলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য খাত এখন চরম বাণিজ্যিকীকরণে আক্রান্ত। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবাকে বাণিজ্যের জায়গা থেকে বের করে আনার জন্য দরকার এমন একটি কাঠামো, যেখানে বিনিয়োগ আসবে, সেবা দেওয়া হবে, কিন্তু মুনাফা তুলে নেওয়া হবে না। সামাজিক ব্যবসার মডেল এ ক্ষেত্রেই আদর্শ।”
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “আমরা যদি একটি সামাজিক ব্যবসার হাসপাতাল তৈরি করি, যার মূল লক্ষ্য থাকবে শুধু রোগীসেবা, তাহলে সেখানে সেবা গ্রহণকারীর খরচ কমবে, চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠবে।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল বিজনেসের ধারণা নিয়ে গবেষণা ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম দ্রুতগতিতে বাড়ছে। উন্নত দেশগুলোতেও এই ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবায় সামাজিক ব্যবসার মডেল কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা গ্লোবাল গ্রামীণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যে সামাজিক ব্যবসা কার্যক্রম চালাচ্ছি, তাতে দেখা গেছে—যেসব প্রকল্পে মুনাফার বদলে মানবিক প্রয়োজন মেটানোর অঙ্গীকার রয়েছে, সেগুলো টেকসই হচ্ছে, সামাজিক প্রভাব বাড়ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটছে।”
দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী ৩৮টি দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ডিপ্লোম্যাট, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এবং ইউনূস সেন্টার ও গ্রামীণ ট্রাস্টের সহযোগী সংগঠনসমূহ। বিভিন্ন প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা সামাজিক ব্যবসার নানা দিক তুলে ধরেন, যেমন: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সোশ্যাল বিজনেস, স্বাস্থ্যসেবায় উদ্ভাবনী উদ্যোগ, যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সোশ্যাল ইনোভেশন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী নেতৃত্বের প্রসার।
বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের সোশ্যাল বিজনেস পরিকল্পনা নিয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। এতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানে তাদের ভাবনাগুলো উপস্থাপন করেন।
কূটনৈতিক উপস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক বার্তা
সোশ্যাল বিজনেস ডে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক। তাঁরা সামাজিক ব্যবসাকে কেবল তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক সমাধানের পথ হিসেবে স্বাগত জানান।
জার্মান রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে বলেন, “আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে বৈষম্য ও বৈশ্বিক সংকট বেড়েই চলেছে। এর সমাধানে সামাজিক ব্যবসা একটি শক্তিশালী বিকল্প পথ। আমরা এই ধারণাকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অংশ করতে চাই।”
সম্মেলনের শেষ দিনে সামাজিক ব্যবসা ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্পের প্রতিবেদন উপস্থাপন, ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ ঘোষণা এবং নতুন দেশভিত্তিক পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। আয়োজকরা আশা করছেন, এবারের সোশ্যাল বিজনেস ডে আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি আন্তর্জাতিক সাড়া ফেলবে এবং বাংলাদেশের মাটিতে বিশ্বব্যাপী একটি মানবিক বাণিজ্যিক বিপ্লবের সূচনা হবে।
সামাজিক ব্যবসা শুধুই দারিদ্র্য নিরসনের হাতিয়ার নয়, এটি হতে পারে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নৈতিক ও মানবিক অর্থনীতি গড়ার পথ। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন এখন সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ