
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ১৪৭টি আবেদন জমা পড়েছে। এ তালিকার বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে তথাকথিত 'প্যাডসর্বস্ব' দল, যাদের নেই দৃশ্যমান সাংগঠনিক কাঠামো, গঠনতন্ত্র কিংবা একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও। অনেকেই আবেদনে যেসব ঠিকানা দেখিয়েছে, সেগুলো আদতে রাজনৈতিক কার্যালয় নয়—কোনোটিতে ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস ব্যবসা, কোথাও সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস, আবার কোথাও সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন এক ঠিকানা।
নিবন্ধনের আবেদনের সময় একাধিক দল শুধু দলীয় প্যাডে একটি সাধারণ দরখাস্ত জমা দিয়েছে, সঙ্গে কোনো কাগজপত্র দেয়নি। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, একেক নির্বাচনের আগে এমন শত শত আবেদন আসে, যাদের পরে আর কোনও কার্যক্রম দৃশ্যমান থাকে না। এবারও সেই ইতিহাসের ব্যতিক্রম নয়।
চলতি বছরের ২২ জুন নিবন্ধনের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ পর্যন্ত ইসিতে জমা পড়ে ১৪৭টি আবেদন, যা এসেছে ১৪৪টি দল থেকে। ৩টি দল দুইবার করে আবেদন জমা দিয়েছে। ইসির ২০ জন কর্মকর্তা এখন এসব আবেদনের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করছেন। তাদের মতে, প্রথম ধাপে যেসব ৬৫টি দল আবেদন করেছে, তাদের মধ্যে ১৪টি দল কেবলমাত্র প্যাডে আবেদন জমা দিয়েছে। তাদের কোনো গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, সদস্য তালিকা কিংবা কার্যকরী কমিটি জমা পড়েনি।
দ্বিতীয় ধাপে আরও ৭৮টি দল আবেদন করে, যাদের বেশিরভাগই একইভাবে অসম্পূর্ণ কাগজপত্র জমা দিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি দলের আবেদন হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, কারণ তারা যে কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে গিয়ে দেখা গেছে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই, কেউ দলটির নামও জানে না।
"জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি" নামের একটি নতুন দল তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসাবে উল্লেখ করেছে ইসলাম টাওয়ার, নয়াপল্টন, ঢাকার ৭ম তলা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। বরং সেখানে "আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস" নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস। জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানের মালিকই দলটির সাধারণ সম্পাদক। দলের কোনো গঠনতন্ত্র নেই, সদস্য তালিকাও জমা পড়েনি।
দলটির চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, হুট করে দল গঠন করে জমা দিয়েছি, তাই প্রস্তুতি নিতে পারিনি। এখন একটি অফিস খোঁজা হচ্ছে, আর গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
আরেক নতুন দল "নতুন বাংলাদেশ পার্টি (এনবিপি)" তাদের দলীয় কার্যালয় হিসাবে উল্লেখ করেছে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের একটি ভবনের ঠিকানা। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ছয়তলায় ঝুলছে একটি ব্যানার, কিন্তু কোনো দলের উপস্থিতি বা কার্যক্রম নেই। বরং ওই তলায় একটি সিকিউরিটি কোম্পানির অফিস চালু রয়েছে। ভবনের দারোয়ান এবং স্থানীয়দের মতে, এখানে রাজনৈতিক দলের কোনো কার্যক্রম ছিল না।
দলটির মহাসচিব দয়াল কুমার বড়ুয়া জানিয়েছেন, অফিস আপাতত উত্তরা থেকে সরিয়ে মালিবাগ ও মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় নেওয়া হয়েছে। অথচ ইসিকে অফিস হিসাবে দেখানো হয়েছে উত্তরার ঠিকানাটি।
"জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি" দাবি করেছে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকার দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই ঠিকানায় কোনো বাড়ি-ঘরই নেই, কেবল খালি জায়গা। পরে দলটির নেতারা সাংবাদিকদের নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী একটি এক কামরার অফিসে, যেখানে কোনো রাজনৈতিক চিহ্ন বা সাইনবোর্ড নেই।
চেয়ারম্যান শাহজালাল চৌধুরী একজন ওষুধ ব্যবসায়ী, আর সাধারণ সম্পাদক সাপ্তাহিক পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি। তারা জানান, শর্ত পূরণ করেছি, সাইনবোর্ড তৈরি হচ্ছে, পরে ঠিকানা পরিবর্তন করে জানানো হবে।
আরও কয়েকটি দলের আবেদনে উল্লেখ রয়েছে যে, তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকায় নেই। যেমন "বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি" গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে একটি গ্রামে দলীয় কার্যালয় উল্লেখ করেছে। আবেদনপত্রে দলীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও নেই। দলের চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিন জানান, কিছু ভুল হয়েছে, তাই আবার আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় চেয়েছেন।
"কোয়ালিশন ন্যাশনাল পার্টি" বান্দরবানে, "বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি" খুলনায়, "মানবিক বাংলাদেশ পার্টি" ও "বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি" গাজীপুরে, আর "বাংলাদেশ গণবিপ্লবী পার্টি" সাতক্ষীরায় তাদের প্রধান কার্যালয় দেখিয়েছে। কিন্তু এসব দলের ঢাকায় কোনও কেন্দ্রীয় কার্যক্রম নেই।
বনানীর হাইটস হাউজে অবস্থিত "জনতার দল" এর অফিসে তালা ঝুলতে দেখা যায়। দারোয়ান জানান, মাঝে মাঝে ২-৩ জন আসে, তাদের সম্পর্কে কিছু জানা নেই। ফোন নম্বর দিয়েও সাংবাদিকরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে নির্ধারিত ১০টি তথ্য এবং ৫ হাজার টাকার ফি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে দলীয় গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, কার্যকরী কমিটি, ২০০ জন ভোটারের সমর্থনপত্রসহ অনেক কিছুই আছে। এসব শর্ত পূরণ না করলে কোনো দলই নিবন্ধন পাবে না।
তিনি আরও জানান, আবেদন যাচাইয়ের পর আমরা কেবল সেই দলগুলোকে বিবেচনায় নেব যারা শর্ত পূরণ করেছে। নির্বাচন সামনে এলেই অনেকেই কাগজপত্র ছাড়া দল গঠন করে আবেদন জমা দেয়। বাস্তবে খুব অল্প কয়েকটি দলই নিবন্ধনের যোগ্য হয়।
রাজনৈতিক দল গঠনের পেছনে গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা যতটা না কাজ করে, তার চেয়ে বেশি যেন কাজ করছে নিবন্ধনের কাগজ জোগাড় করে বড় দলের ছায়াতলে সুবিধা পাওয়ার চিন্তা। এ চিত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতাকেই আবারও সামনে এনে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের উচিত বাস্তব ভিত্তিক যাচাই ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসব কাগুজে দল বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রামাণ্য তথ্যসমৃদ্ধ, মাঠপর্যায়ে সক্রিয় দলগুলোকেই স্বীকৃতি দেওয়া।
বাংলাবার্তা/এমএইচ