
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও নিন্দিত জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদন আগামী সোমবার (১২ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দপ্তরে দাখিল করা হবে। এই তথ্য শুক্রবার (৯ মে) দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে নিশ্চিত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ-সদৃশ মানবতাবিরোধী অপরাধে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাল বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে তদন্তাধীন থাকা এই মামলায় বহু নিরস্ত্র ছাত্র, তরুণ এবং সাধারণ নাগরিক হত্যার অভিযোগ রয়েছে, যার দায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক নির্দেশনায় পরিচালিত সরকারি বাহিনীর ওপর বর্তায়।
চিফ প্রসিকিউটর তার পোস্টে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট আগামী সোমবার আমার কার্যালয়ে দাখিল করবে বলে আশা করছি। এরপর ‘ফরমাল চার্জ’ দাখিলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে বিচারকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “ইতোমধ্যে চানখারপুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডটি ছিল জুলাই গণহত্যার অন্যতম নির্মম ঘটনা, যেখানে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি চালিয়ে ২৭ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, এই হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত।”
চিফ প্রসিকিউটরের ভাষায়, “চলতি সপ্তাহেই চানখারপুল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হবে। এর মাধ্যমে জুলাই গণহত্যার বিচারের সূচনা ঘটবে।”
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পটভূমি ছিল ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বৈষম্য, নিপীড়ন এবং বেকারত্ববিরোধী ছাত্র-তরুণ আন্দোলন। সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার—যার প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা—এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সহস্রাধিক নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ভিডিও প্রমাণ অনুযায়ী, আনুমানিক দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যার অধিকাংশই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যুবক এবং বেকার আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষ। ঢাকার নিউমার্কেট, রাজারবাগ, চানখারপুল, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও ‘সাদা পোশাকে’ থাকা সরকারের সমর্থক বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ৫ আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাপ এবং আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
নতুন সরকারের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে সাধারণ নাগরিকের রক্ত ঝরাতে না পারে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে সম্পন্ন করতে তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর তদন্ত সংস্থার সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল সময়সীমা কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।
এই মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত চিফ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব, বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এবং আরও ৪৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা সরাসরি এই গণহত্যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা বা বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই মামলাটি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক মনোযোগ কাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এই বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার কমিশনার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “যদি গণহত্যার অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয়, তবে এটি হবে ২১শ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘটিত অন্যতম ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতা।”
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের মতে, “জুলাই গণহত্যা ছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির চরম অপব্যবহার। এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার জনগণের বিরুদ্ধে এমন নৃশংসতা চালাতে সাহস পাবে না।”
তিনি আরও জানান, তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে চার্জ গঠনের পর আদালতে সুনির্দিষ্ট শুনানি শুরু হবে, যেখানে সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও ফরেনসিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে ৩৫ জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও ১১টি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে, যা বিচারকার্যে ব্যবহৃত হবে।
এই বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায় পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ